শিকারিদের উৎপাতে কর্ণফুলীতে কমছে অতিথি পাখি

শীতের শুরু থেকে অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে থাকাই চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদী, পারকি সমুদ্র সৈকত, মেরিন একাডেমী, কেইপিজেড লেকের স্বাভাবিক চিত্র। বেশ কয়েক বছর ধরে এসব এলাকাকে নিজেদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নিয়েছে শীতের অতিথি পাখিরা। প্রতিবছর এখানে আসে অসংখ্য অতিথি পাখি। তবে সময় যত সামনে বাড়াচ্ছে ততই কমছে এসব অঞ্চলে অতিথি পাখির আগমনের সংখ্যা। আর এর পেছনে আছে পরিবেশের পরিবর্তন এবং শিকারিদের উৎপাত।

প্রতি বছরের মতো এবারও কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরে উপকূল এলাকাগুলো হাড় কাঁপানো শীত শুরুর আগে বিভিন্ন প্রজাতির দেশি-বিদেশি পাখির আগমনে মুখরিত হয়ে উঠেছে। পাখিদের অভয়াশ্রম হিসেবে পরিচিত এসব এলাকায় ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ী পাখির আগমনে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে মৌসুমি বিনোদনে। প্রতিদিন এখানে পাখির কলতান উপভোগ করতে দূর-দূরান্ত থেকে আসছেন পাখিপ্রেমীরাও। তবে বছর ঘুরে এখন শীতে আসা পাখির সংখ্যা অনেকটা কমে যাওয়াও কিছুটা হতাশ হতে হচ্ছে পাখিপ্রেমীদের। তারা বলছেন, অতিথি পাখিদের রক্ষায় আমাদের আরও আন্তরিকতা প্রয়োজন।

স্থানীয়রা জানান, পাখির আবাসস্থল ধ্বংস, খাদ্য সংকট ও জমিতে কীটনাশক প্রয়োগের ফলে দিন দিন পরিযায়ীসহ অতিথি পাখির সংখ্যা কমছে। পাশাপাশি গাছ কেটে বন উজাড়ে হারিয়েছে পাখিদের স্বাভাবিক পরিবেশ। এছাড়া পাখির আবাসস্থল রক্ষায় স্থানীয় বা সরকারিভাবে কোনো কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে অতিথি পাখিরা।

স্থানীয় বারশত ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্য এমএ কাইয়ূম শাহ্ বলেন, পারকি সৈকতে শীতের সময়ে অনেক অতিথি পাখির আগমন ঘটে। অতিথি পাখিগুলো আমাদের দেশে এসে সৌন্দর্য প্রস্ফুটিত করার পাশাপাশি আমাদের যথেষ্ট উপকার করে। তাই অতিথি পাখিগুলোকে অতিথির মর্যাদা দেয়া উচিত। এখানে আসা অতিথি পাখি গুলো শিকার না করার অনুরোধ জানান স্থানীদের।

সরজমিনে কর্ণফুলী নদী, পারকি সমুদ্র সৈকত, রায়পুর উঠান মাঝির ঘাট, গহিরা উপকূল, প্যারাবন ও কেইপিজেডের লেকের ধার ঘুরে দেখা যায়, সাগর ,পাহাড় এবং লেকে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে চলা পাখির ডানা ঝাপটানোর দৃশ্য। নানা বর্ণের ছোট-বড় দেশিও পরিযায়ী পাখি। সব মিলিয়ে পাখিদের অভয়াশ্রমে অন্য রকম এক আবহ তৈরি হয়েছে এখানে। কেপিজেডের সড়ক দিয়ে যেতেই দেখা মিলে অতিথি পাখির। নিজেদের বাঁচার প্রয়োজনে এরা হাজার হাজার মাইল পথ উড়ে বছরের এ সময়টাতে এখানে আসে। অনেকেই আবার দুই-আড়াই মাস পর চলে যায়, কেউবা স্থায়ীভাবে থেকে যায়। আর এসব পাখি বেড়াতে আসা পর্যটকদের ভ্রমণে যোগ করছে বাড়তি আনন্দ।

এখানে আসা শতাধিক প্রজাতির অতিথি পাখির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- কুস্তি হাঁস, জিরিয়া হাঁস, পাতারি হাঁস, রাজ হাঁস, নীলশির, কানি বক, ধূসর বক, সাদা বক, জল ময়ূর, ডুবুরি, পানকৌড়ি, গঙ্গা কবুতর, দলপিপি, রাজসরালি।

শিকারিদের উৎপাতে কর্ণফুলীতে কমছে অতিথি পাখি 1

শীত মৌসুম শেষ হওয়ার পর অধিকাংশ পাখি ফিরে গেলেও পানকৌড়ি ও কিছু বক পাখি এখানে স্থায়ীভাবে থেকে যায় বলে জানিয়েছেন কেইপিজেডের উপ মহা ব্যবস্থাপক মো. মুশফিকুর রহমান।

কেইপিজেডের ভেতরে লেকের দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে আনোয়ারা সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী জাকিয়া সুলতানা শাকি বলেন, লেকের ধারে অসংখ্য পাখি এখানে। উড়ছে তারা আকাশ আপন নীড়ে। দেখে অনেক ভালো লাগছে।

চট্টগ্রাম শহর থেকে বেড়াতে আসেন বার্ড ওয়াচার আহসান উদ্দিন চৌধুরী। তিনি বলেন, শীতের প্রকোপ কমে গেলে অতিথি পাখিরা আবার ছুটে চলে নিজ ভূমিতে। বাংলাদেশে অবকাশ যাপনের ইতি ঘটিয়ে আপন ভূমিতে যাওয়ার জন্য আবারও হাজার মাইল পাড়ি দেয় তারা। তবে যে নিরাপত্তার জন্য এ দেশে তারা আসে, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে কিছু অসাধু মানুষ বিভিন্ন সময় তাদের শিকার ও হত্যা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে স্থানীয় প্রশাসনকে সজাগ দৃষ্টি রাখারও আহ্বান জানাচ্ছি।

কেইপিজেডের চারটি ইউনিটের হেড অব এডমিন ও চাতরী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আফতাব উদ্দিন চৌধুরী সোহেল বলেন, পরিযায়ী পাখি আমাদের দেশের জন্য আশীর্বাদ। এসব পাখি আমাদের প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে। সড়ক দিয়ে যাওয়ার পথে পাখির কিচিরমিচির শব্দে প্রতিনিয়ত মুগ্ধ হই। ইচ্ছে করে কিছুক্ষণ বসে থাকি। দেখছি প্রাণভরে, মন জুড়াচ্ছে ঘুরে ফিরে। এ যেন এক পাখিদের বাড়ি।

কেইপিজেডের উপ মহা ব্যবস্থাপক মো. মুশফিকুর রহমান বলেন, জীব বৈচিত্র্য রক্ষায় কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ নানা উদ্যোগ নিয়েছে এখানে। পাখির অভয়াশ্রম সৃষ্টির জন্য ১৭টি কৃত্রিম লেকে পাখিদের জন্য আবাসন সৃষ্টি হয়েছে। শীতের মৌসুমে অতিথি পাখির আগমন ঘটে বেশি। ডিসেম্বর মাসে সবচেয়ে বেশি পাখির দেখা এখানে মিলে। তবে কেউ যাতে পাখি শিকার করতে না পারে সেজন্যও কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারী রয়েছে বলেও জানান তিনি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেছেন, আমাদের দেশে প্রতিবছর শতাধিক প্রজাতির অতিথি পাখি আসে। এরা সাধারণত নিরিবিলি এলাকা বেছে নেয়। তবে খাদ্য সংকট ও উপযুক্ত পরিবেশ না পাওয়ার কারণে ইদানীং অতিথি পাখি আসার হার আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে। নানা কারণের মধ্যে দুটি কারণ হলো- যেসব এলাকায় এসব পাখি আশ্রয় নেয় তার পরিবেশ বিঘ্নিত হওয়া ও শিকারিদের উৎপাত।

তিনি আরও বলেন, পাখি শিকার করা আইনত অপরাধ। এ বিষয়ে নজরদারি ও সচেতনতা প্রয়োজন বলেও জানান তিনি।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে অতিথি পাখির আগমন ঘটে উত্তর মেরু থেকে। পৃথিবীর উত্তর মেরুর দেশ সাইবেরিয়া, ফিলিপস, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, ফিনল্যান্ড, এন্টার্কটিকাসহ অনেক অঞ্চলে তাপমাত্রা যখন মাইনাস শূন্য ডিগ্রিতে নেমে আসে, তখন সেগুলোতে দেখা দেয় খাদ্যাভাব। তীব্র শীতে পাখির দেহ থেকে পালক খসে পড়ে।

প্রকৃতি যখন পাখিদের জীবনধারণের জন্য অনুকূলে থাকে না, তখন পাখিগুলো অপেক্ষাকৃত কম শীত ও অনুকূল প্রকৃতির দেশে অতিথি হয়ে আসে। নাতিশীতোষ্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে প্রতিবছর সাদরে গ্রহণ করে নেয় এসব অতিথি পাখিকে। এ দেশ হয়ে ওঠে তখন অতিথি পাখিদের খাদ্য ও জীবনধারণের নিরাপদ আবাসস্থল।

সৃষ্টিগতভাবে পাখিদের শারীরিক গঠন খুবই মজবুত। তাই অতিথি পাখিরা ৬০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ মিটার উঁচু আকাশসীমা পাড়ি দিয়ে উড়ে আসতে পারে। বড় পাখিরা ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার অনায়াসে উড়তে পারে আর ছোট পাখিরা উড়তে পারে ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার। দিনে-রাতে মোট ২৪ ঘণ্টায় তারা প্রায় ২৫০ কিলোমটার পাড়ি দিতে পারে।

কিছু পাখি বছরে প্রায় ২২ হাজার মাইল পথ অনায়াসে পাড়ি দিয়ে চলে আসে এই দেশে। বেশির ভাগ অতিথি পাখিদের আগমন ঘটে ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দেখা মেলে অতিথি পাখিদের। এসব অতিথি পাখির কিচিরমিচিরে মুখর থাকে পুরো প্রকৃতি।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।