আইনশৃংখলা রক্ষা এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় পুলিশের কোনো বিকল্প নেই

পুলিশ (Police) মানে (Polite, Obedient, Loyal, Intelligent, Courageous, Energetic)-অর্থাৎ একজন মানুষের মধ্যে যখন এ ধরনের অসাধারণ গুণাবলীর সমন্বয় ঘটে থাকে তখন তিনি পুলিশ সদস্য হওয়ার গৌরব অর্জন করেন।

পুলিশ দেশের প্রধান আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় পুলিশ সার্ভিস আবার কোয়াশি জুডিশিয়াল (Quasi Judicial) সার্ভিস। একটা দেশের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার সফলতা ও বিফলতা নির্ভর করে অনেকটা পুলিশের কর্মক্ষমতার (performance) ওপর। অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে আছে বিজিবি ও আনসার-ভিডিপি।র‌্যাব পুলিশেরই একটি ইউনিট।

পুলিশ এমন একটি সরকারী বাহিনী, যার মূল কাজ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক রাখা এবং সকলের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে আইনের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। রাষ্ট্রের আইন শৃংখলার সার্বিক উন্নয়ণের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান সহযোগী শক্তি হচ্ছে পুলিশ।

অনেক প্রতিকুলতা, সীমাবদ্ধতা, বৈষ্যম্য আর অপবাদ, অবজ্ঞা, ঘৃণা, ধিক্কার, লাঞ্চনা-গঞ্চনা ব্যাপক সমালোচনার মধ্যেও বিরতিহীন নিরাপত্তায় ২৪ ঘন্টা শান্তির প্রহরী, সেবক, বন্ধু হিসেবে দায়িত্ব পালনে জীবনবাজি রেখে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকে পুলিশ বাহিনী। জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশে সশস্ত্র, পুলিশ বাহিনী ব্যপক প্রশংসা কুড়িয়েছে।মহান মুক্তিযুদ্ধেও পুলিশের ভূমিকা অনন্য ছিল।এছাড়াও বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা সমগ্র বিশ্বে রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃত।

বাংলাদেশ পুলিশবাহিনী জনবান্ধব পুলিশিংয়ের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, আইন শৃংখলাকে সমুন্নত রাখতে প্রত্যেক পুলিশ সদস্য পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।মানুষের জীবনে শান্তি-নিরাপত্তার জন্য নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও তারা কাজ করেছে।
রাস্তায় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা সঠিক ও কলুষমুক্ত রাখার দায়িত্ব বাংলাদেশ পুলিশের। রাস্তায় দায়িত্ব পালনকালে পুলিশ সদস্যদের মিডিয়া ট্রায়ালেরও স্বীকার হতে হয়। পুলিশ হাইওয়ে সড়ক, মহাসড়কে রাস্তা নিরাপদ রাখতে কাজ করে। সন্দেহজনক স্পটে নিয়মিত টহল দেয় পুলিশ।

বাংলাদেশের সকল সঙ্কটের ত্রাতা হয়েও আবির্ভাব ঘটে পুলিশের, বিশেষ করে বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে উত্তরণের জন্য পুলিশকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসতে হয়।

আইন শৃংখলা রক্ষায় পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট যেমন মেট্রো পুলিশ, জেলা পুলিশ,থানা পুলিশ, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ, ট্রাফিক পুলিশ,ট্যুরিস্ট পুলিশ, নৌ পুলিশ, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন, অ্যান্টি টেরোরিজম, কাউন্টার টেরোরিজম,গোয়েন্দা পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে।সাম্প্রতিক সময়ে বিট পুলিশিং প্র্যাকটিস চালু হয়েছে।

জাতীয় যেকোনো সংকটে, দুর্যোগ ও দুর্বিপাকে পুলিশ সাহায্যের হাত প্রসারিত করে জনগণের পাশেই থাকে। স্মরণকাল থেকেই পুলিশ জনগণের সঙ্গে থেকে নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি মানবিক কাজ করে আসছে। ভয়ভীতি উপেক্ষা করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পুলিশ তাদের মহান দায়িত্ব পালনে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছে।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে সকলের জন্য নিরাপদ ও নিয়ন্ত্রণ করার স্বার্থে পুলিশ সদস্যদের আত্মাহুতি দানের অজস্র নজির রয়েছে।
সেই পুলিশকে যখন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে ব্যবহার করা হয়, নিরীহ ও অসহায় মানুষকে গ্রেফতার করে,তখন তা শুধু আইনের প্রতি মানুষের আস্থা ক্ষুণ্ন করে না, বরং পুরো সরকারের ভাবমূর্তিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং পুলিশ তখন সাধারণ মানুষের সমর্থনও হারায়।
কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে পুলিশকে শিক্ষার্থীদের প্রজ্জ্বলিত আগুনের সামনে দাড় করানো হয়, বেশকিছু ছাত্র জনতা মারা যায়,যারজন্য শিক্ষার্থী,শিক্ষক, অভিভাবকসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ সরকার এবং পুলিশের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়।ছাত্র জনতার গণ অভ্যুত্থানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী (সাবেক) দেশ ত্যাগ করলে কিছু উচ্ছৃংখল নাশকতাকারীর ক্ষোভের মুখে পড়েন পুলিশ।বেশকিছু পুলিশ সদস্যকে নৃশংশভাবে খুন করা হয় ।এতে করে ননক্যাডার পুলিশ কর্মকর্তা ও পুলিশ সদস্যারা যুগপৎভাবে হতাশ ও সংক্ষুব্দ হয়। পুলিশের চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে পড়ে, দেশব্যাপী ক্রম অবনতিশীল নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে,থানা আক্রমণ হয়েছে।যা কখনো কাম্য ছিলোনা।

এই নাশকতার যদি বিচার না হয় তাহলে পুলিশ তার মনোবল হারাবে। যারা থানায় আক্রমণ করেছে পুলিশ মেরেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া প্রয়োজন।
পাশাপাশি বাংলাদেশের বর্তমান সংস্কৃতিতে পুলিশ সদস্যদের নিরাপত্তার বিষয়টি আরও গভীরভাবে চিন্তা করা উচিত।

এখন আমাদের সকলের দায়িত্ব পুলিশ ও জনতার দূরত্ব কমিয়ে আনা,এবং সেবাপ্রার্থীর সঙ্গে পুলিশের সদাচরণ ও মানসম্মত সেবা প্রদানের মাধ্যমে মানুষের মন জয় করা।এই শুদ্ধাচার কখনো নীচ থেকে সম্ভব নয়,পুলিশের উপরের মহল শুদ্ধ হলে নীচের মহল আপনা আপনিই শুদ্ধ হয়ে যাবে।

পুলিশ ছাড়া কোনো রাষ্ট্র, কোনো সমাজ চিন্তা করা যায় না। পুলিশের প্রয়োজন সর্বত্র। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কলকারখানা, শিক্ষাঙ্গন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তায়—সব জায়গায়ই নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং অপরাধ দমনের জন্য পুলিশের উপস্থিতি ও হস্তক্ষেপ একান্ত প্রয়োজন। পারিবারিক সংঘাত, দাম্পত্য কলহ, টাকা-পয়সা লেনদেন ইত্যাদি সামাজিক সমস্যায় এবং পুলিশের এখতিয়ারবহির্ভূত বিষয়েও পুলিশকে হস্তক্ষেপ করতে হয় সমস্যার সমাধান বা শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য। পুলিশ ছাড়া ঢাকা শহরে ডাকাতের হিড়িক পড়েছে,জানিনা গুজব কিনা।তবে এটা ঠিক যে, জনগণের জান মাল নিরাপত্তাহীন থাকবে।

রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিকভাবে যারা খুব গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে বিরাজ করেন, তাদের বিশেষ নিরাপত্তা প্রদানের কাজটি বাংলাদেশ পুলিশকেই করতে হয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিবর্গ ও অন্যান্য যারা গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থেকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করছেন, প্রত্যেককে নিরাপত্তা প্রদানের কাজটি করতে হচ্ছে বাংলাদেশ পুলিশকেই।

এছাড়াও রাষ্ট্রীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিরাপত্তা প্রদানের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হচ্ছেন বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা। অন্যদিকে বিদেশী গুরুত্বপূর্ণ অতিথি, বিদেশী দূতাবাস ও কূটনৈতিক পাড়ায় নিরাপত্তার দায়িত্বও বাংলাদেশ পুলিশের কাঁধেই বর্তায়।

তাই পুলিশবাহিনীকে কখনো কোনো রাজনৈতিক দলের স্বার্থে ব্যবহার করা উচিত নয়।এই সত্যটি যখন জনগণের কাছে দৃশ্যমান ও বিশ্বাসযোগ্য হবে তখন আইনশৃংখলা রক্ষার স্বার্থে,জনগণের জান মাল রক্ষার স্বার্থে পুলিশের যে কোনো পদক্ষেপকে সাধারণ মানুষ সাধুবাদ জানাবে।অতীতের সরকারগুলোও পুলিশকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করেছিল।

তবে এবার একটি বিষয় ষ্পষ্ট হয়েছে যে, থানায় হামলার সাথে, পুলিশ খুন এর সাথে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোনো সম্পৃক্ততা ছিলোনা।এর পিছনে একটা অশুভ শক্তি কাজ করেছে।তাই এসব নাশকতাকারীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যাবস্থা করা না হলে পুলিশ সহজে মনোবল ফিরে পাবেনা।
এই ক্ষত মুছে যাবার নয়।

মান্যবর নবাগত আইজিপি মহোদয় চমৎকার মেসেজ দিয়েছেন, আমার বিশ্বাস মাননীয় সেনা প্রধান ও আইজিপি মহোদয়ের আশ্বাসের পর পুলিশের মধ্যে আর আস্থার সংকট থাকার কথা নয়।
তবে ক্যাডার – নন ক্যাডার এর যে দূরত্ব তৈরী হয়েছে কিছু সংস্কারের মাধ্যমে সেই দূরত্বও কমিয়ে আনা উচিত।এটাযে শুধু পুলিশবাহিনীতে আছে তা নয়,সরকারের সব সেক্টরে আছে।

ব্যক্তিগতভাবে আমি অনেক পুলিশ কাডারের সদস্যকে চিনি যারা অনেক নিরহংকার ও মানবিক মানুষ, বাহিনীর নিম্নপদস্থ সদস্যদের প্রতিও বেশ দরদী। ২/১ জন অতি উৎসাহী ব্যক্তি সবখানে থাকতে পারে। পরিবারের সব ভাইয়ের চরিত্রও এক হয়না। এই বাস্তবতাকেও মানতে হবে।
পুলিশ ভাইদের প্রতি আমার অনুরোধ থাকবে-পরিবার, সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে হলেও আপনারা কর্মস্থলে ফিরে আসুন।
দেশমাতৃকার দিকে তাকিয়ে হলেও রাষ্ট্রকে এই সংকট থেকে উদ্ধারের জন্য কাজে যোগদান করুন প্লীজ।পাশাপাশি আমাদের সকলের উচিত পুলিশবাহিনীকে সহযোগিতা করা।
যে সকল পুলিশ ভাই, শিক্ষার্থী ও নিরিহ জনগণ মৃত্যু বরণ করেছেন তাদের সকলের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।