ইসলামের পঞ্চ ভিত্তির অন্যতম হলো মাহে রমজানের রোজা। নামাযের পরই রোজার স্থান। মাহে রমজান রহমত-বরকত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস। মানুষের দৈহিক, মানসিক, আত্মিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নয়নের মাস রমজান। সংযম, সহিষ্ণুতা ও আত্মশুদ্ধির অনন্য চেতনায় ভাস্বর পবিত্র রমজান। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মাসকে এক সুমহান মাস হিসেবে অভিহিত করেছেন।
পবিত্র কুরআন ও হাদীস শরীফে রোজার ফাযায়েল বর্ণিত হয়েছে। আমরা রোজার ফাযায়েল-মাসায়েল কমবেশি জানলেও রোজাকে পবিত্র ও ত্রুটি মুক্ত রাখার বিষয়টি অনেকেই জানিনা বা জানলেও মেনে চলার চেষ্টা করি না। মহান আল্লাহ তায়া’লার নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের আশায় ১২/১৪ ঘন্টা উপোস থেকে,কষ্ট করে রমজানের রোজা রাখছি কিন্তু আমার রোজা আল্লাহ তায়া’লার দরবারে কবুল হচ্ছে না। সওয়াব পাচ্ছি না। সাহরী থেকে ইফতার পর্যন্ত উপোস থাকা ছাড়া কিছু অর্জন হচ্ছে না।
হাদীস শরীফে আছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-অনেক রোজাদার এমন আছে যে, তাদের রোজা থেকে উপোস থাকা ছাড়া আর কিছুই অর্জিত হয় না। আর অনেক রাত্রি জেগে এবাদতকারী এমন আছে যে, তাদের সে এবাদত থেকে রাত্রি জাগরণ ছাড়া আর কিছুই থাকে না।
(মিশকাত: ১১৭)
★ যে সব কারণে আমাদের রোজা ত্রুটিযুক্ত হয় এবং সওয়াব কম হয়।
রোজা রেখে মিথ্যা কথা বললে সে রোজা ত্রুটিযুক্ত হয়ে যায়। আল্লাহ তায়া’লার নিকট কবুল হয় না। হাদীস শরীফে আছে,রাসুল সা. ইরশাদ করেন- যে ব্যক্তি (রোজা রেখে) মিথ্যা কথা বলা ও তার উপর আমল করা পরিহার করল না, তার পানাহার বর্জন আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই । (বুখারী ১৯০৩, ৬০৫৭)।
মিথ্যা কথা ও মন্দ কাজ পরিত্যাগ না করলে তার পানাহার বর্জনে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই এর ব্যাখ্যা হল, রোজার উদ্দেশ্য হচ্ছে মনোবাসনাকে পরিত্যাগ এবং কুমন্ত্রণা দানকারী আত্মাকে বশে আনা। অতএব রোজা রেখে যখন এর উদ্দেশ্য অর্জন করা যায়নি তখন সেই রোজার পরওয়া আল্লাহ পাক করেন না। অতএব,আল্লাহর প্রয়োজন না হওয়ার অর্থ দাঁড়াল, আল্লাহ তায়া’লা তার রোজার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করেন না এবং কবুল করেন না। ( ফয়জুল কালাম-৩৯৮)
মিথ্যা কথা বলা মারাত্মক বড় একটি গুনাহ। মিথ্যা ইসলামের দৃষ্টিতে অতি গর্হিত, অবশ্য-বর্জনীয়। মিথ্যাবাদিতা মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ মিথ্যাবাদীর শাস্তির কথা উল্লেখ করে ইরশাদ করেছেন, ‘তাদের হৃদয়ে আছে একটি রোগ, আল্লাহ সে রোগ আরও বেশি বাড়িয়ে দিয়েছেন, আর যে মিথ্যা তারা বলে তার বিনিময়ে তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
(সুরা বাকারা, আয়াত : ১০-১২)।
আল্লাহ তায়ালা বলেন- মিথ্যা তো তারাই বানায় যারা আল্লাহর নিদর্শন
সমূহের ওপর ঈমান রাখে না। বস্তুত তারাই মিথ্যাবাদী। (সূরা নাহল, আয়াত-১০৫)।
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে : ‘মিথ্যাবাদীদের উপর অভিসম্পাত।’
(আল-ইমরান-৬১) আল্লাহ তায়া’লার লা’নত বা অভিশাপের চেয়ে বড় বিষয় আর কি হতে পারে!
★ মিথ্যা জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাদি.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘সত্যবাদিতা হচ্ছে শুভ কাজ। আর শুভ কাজ জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়। আর বান্দা যখন সত্য বলতে থাকে, একসময় আল্লাহর নিকট সে সত্যবাদী হিসেবে পরিগণিত হয়। আর মিথ্যা হচ্ছে পাপাচার, পাপাচার জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়, বান্দা যখন মিথ্যা বলতে থাকে, আল্লাহর নিকট একসময় সে মিথ্যুক হিসেবে গণ্য হয়। (বুখারি, হাদিস নং: ৫৭৪৩; মুসলিম, হাদিস নং: ২৬০৭)।
রোজাকে ত্রুটি মুক্ত করে আল্লাহর দরবারে কবুলযোগ্য করতে এই মাহে রমজানে মিথ্যা বলা থেকে বাঁচতে হবে।
★ রোজা রেখে গালমন্দ ও অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ করা যাবে না।
আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- যখন তোমাদের কারো সিয়ামের দিন হবে, সে যেন অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ না করে ও হৈ-হট্টগোল না করে। আর যদি কেউ গালাগালি করে অথবা তার সাথে লড়াই ঝগড়া করে, তাহলে সে যেন বলে যে, ‘আমি সিয়াম পালনকারী। (বুখারী-১৯০৪, মুসলিম- ২৭৬২)
অন্য হাদীসে আছে,রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- কেবল পানাহার থেকে বিরত থাকার নামই সিয়াম(রোজা) নয়। সিয়াম তো অসার, বাজে ও অশ্লীল কথা থেকে বিরত থাকার নাম। যদি তোমাকে কেউ গালি দেয় অথবা তোমার সাথে কেউ মূর্খামি করে তবে তাকে বল, ‘আমি রোজাদার, আমি রোজা রেখেছি।” (হাকেম ১৫৭০, বাইহাক্বী ৮০৯৬, ইবনে খুযাইমা ১৯৯৬, সহীহুল জামে’ ৫৩৭৬)।
যে ব্যক্তি রোজা রেখে মিথ্যা বলা মিথ্যা,মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া, মিথ্যা অপবাদ দেওয়া,গীবত করার মত অপরাধ থেকে বিরত হয় না তার রোজা রোজা নয় বরং থাকা উপবাস থাকা। সে রোজার কোন সওয়াব পায় না তবে ফরজ আদায় হয়ে যায়।
শুধু পানাহার বর্জন করার নামই রোজা নয়। কোন কোন মাশায়েখগণ লিখেছেন, রোজা তিন প্রকার (১) সাধারণের রোজা, তারা শুধু পানাহার ও স্ত্রীগমন থেকেই বিরত থাকে। (২) বিশিষ্ট ব্যক্তিদের রোজা, তারা শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও ইন্দ্রিয় শক্তিগুলোকে সব ধরনের আনন্দ উপভোগ, হারাম-মাকরূহ এবং মনোবাসনা পূরণ থেকে বিরত রাখে এবং কুমন্ত্রণা দানকারী আত্মা দমন করার সব পথ অবলম্বন করে। (৩) সর্বোচ্চ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের রোজা, তারা আল্লাহ ব্যতীত অন্য সবকিছু থেকে বিরত থাকে। ( ফয়জুল কালাম-৩৯৮)
মিথ্যা, গীবত,পরনিন্দা ইত্যাদি যাবতীয় গর্হিত কাজ পরিত্যাগ করে আল্লাহ তায়া’লার নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের জন্য রোজা রাখার তাওফীক দান করুন, আমিন।
লেখক
সভাপতি: জাতীয় লেখক পরিষদ হাটহাজারী শাখা
শিক্ষার্থী, উচ্চতর ইসলামি আইন গবেষণা বিভাগ, হাটহাজারী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়।
ই-মেইল: [email protected]
মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।