ইভান হত্যা– ‘অচেনা’ সিএমপির কোতোয়ালী থানা

চট্টগ্রাম নগর পুলিশের (সিএমপি) কোতোয়ালী থানা মানেই ভিন্ন কিছু। ক্লু-লেস ঘটনা উদঘাটন, ভিন্নখাতে প্রবাহমান ঘটনার গতি পরিবর্তন, অজ্ঞাত লাশের শুধু পরিচয় শনাক্ত নয়, কয়েক ঘন্টার মধ্যে খুনী পাকড়াওয়ের রেকর্ড আছে অন্য অনেক থানার মতো কোতোয়ালী থানারও।

কিন্তু ১৭ বছর বয়সী ছাত্রলীগ কর্মী আসকার বিন তারেক ইভান হত্যায় সিএমপি ও কোতোয়ালী থানা ৩ দিন পার করলেও কোনো আসামি গ্রেপ্তার করতে পারেনি। আশ্বাসেই যাচ্ছে চারটা দিন। জনমনে নানা প্রশ্ন উঁকি দিলেও কোতোয়ালী থানার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ থানার কোনো আসামি ধরতে তিন দিনের বেশী সময় লাগাটা অস্বাভাবিক দেখছেন অনেকেই।

কোতোয়ালীর সোনালী অতীত
২০১৩ সালে রেলওয়ের ৪৮ লাখ টাকার টেন্ডার নিয়ে ঝামেলায় সংগঠিত ডাবল মার্ডারের কয়েকঘন্টার মধ্যে ৪৫ আসামি গ্রেপ্তার করেছিল কোতোয়ালী থানা। সেই দলে ছিল কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সম্পাদক সাইফুল আলম লিমন, চবি ছাত্রলীগের সভাপতি আলমগীর টিপুর মতো নেতা। ঠিক রাতের বেলায় ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় যুবলীগের সাবেক অর্থ সম্পাদক হেলাল আকবর চৌধুরী বাবরের মতো প্রভাবশালী নেতাকে।

সিআরবিতে ভোর বেলায় কোতোয়ালীর টহলটিম এক অজ্ঞাত যুবতীর লাশ পায়। লাশ উদ্ধার করে মর্গে পাঠায় কোতোয়ালী থানা পুলিশ। সেই ভাগ্যাহত যুবতীর খুনীর পরিচয় জানাতো দূরের কথা, পরিচয়ও জানা ছিল না কারো। কিন্তু দিনের আলো নেভার আগে পুলিশ খুনীকেও গ্রেপ্তার করেছিল। সেই মামলার রায় হয়েছে ২০২০ সালে।

দুটি ঘটনায় কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ছিলেন একেএম মহিউদ্দীন সেলিম। যিনি বর্তমানে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে সিএমপিতে কর্মরত আছেন।

১১ মে ২০১৯ বাকলিয়ার বলিরহাটে ভাইকে না পেয়ে বুবলী নামের এক গৃহবধুকে তার বাপের বাড়িতে খুন করে মাদক ব্যবসায়ী শাহ আলম। ঘরের পুরুষরা সবাই ছিল তারাবির নামাজে। সেহেরির আগে সেই খুনি শাহ আলম গুলিবিদ্ধ হয় পুলিশের সাথে বন্দুক যুদ্ধে। বাকলিয়ার তৎকালীন ওসি নেজাম উদ্দিন নিজেও সেই বন্দুক যুদ্ধে আহত হয়েছিলেন। সকালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে খুনী আর ভিকটিম দুজনের লাশ পড়েছিল পাশাপাশি। খুন করে দিনের আলো না দেখার একটা নজির তৈরি হয়েছিল সেদিন।

এরকম অসংখ্য ঘটনা এক একটি সোনালী পালক সিএমপির মুকুটে। আরও আছে অনেক সফলতা। বর্তমান সময়ের আলোচিত সারোয়ার-নিক্সন প্রথম যেবার পুলিশের হাতে আটক হয় সেটি ছিল এক সিনেমেটিক ঘটনা। সারোয়ার-নিক্সন বায়েজিদ থানা এলাকার সন্ত্রাসী হলেও মাথা ব্যথা ছিল পুরো সিএমপির। আর টিম কোতোয়ালী সীমান্তবর্তী জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে তাদের ধরে এনে সিএমপিকে টেনশন মুক্ত করেছিল।

ধর্ষীতা নারীকে সীতাকুণ্ড থানা পুলিশ ইয়াবা মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়েছিল। আদালত পুলিশের মামলার এজাহারে সন্দেহ পোষন করে অধিকতর তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছিলেন সিএমপির গোয়েন্দা বিভাগকে। আর গোয়েন্দা বিভাগের তদন্তে ওঠে এসেছিল সেই নারীকে ধর্ষণের পর মেরে লাশ ভেবে রাস্তায় ফেলে গিয়েছিল। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী পুলিশ গিয়েছিল মহিলার লাশ উদ্ধার করতে। কিন্তু গিয়ে দেখে মহিলা মারা যাননি। অপরাধীদের সাথে পুলিশের সখ্যতায় না মরা সেই নারীকে ইয়াবা দিয়ে চালান দেওয়া হয়েছিল আদালতে।

লোহাগাড়ায় অপরহণ হয়েছিল এক শিক্ষার্থী। তার পরিবারের কাছে চাওয়া হয়েছিল ২০ লাখ টাকা মুক্তিপন। অভিযোগ যায় লোহাগাড়া থানায়। স্থানীয় পুলিশের সীমাবদ্ধতা এগিয়ে যায় সিএমপি। সেই শিক্ষার্থীকে জবাই করার সব প্রস্তুতি যখন সম্পন্ন তখন দরজা ভেঙ্গে উদ্ধার করে সিএমপির গোয়েন্দা বিভাগ। আর অহরণকারী ছিল অপহৃত শিক্ষার্থীর আপন খালাতো ভাই।

এরকম অনেক ঘটনা আছে যা সাধারণ নাগরিকের মনে আশা জাগায়। কিন্তু পত্রিকা পাড়ায় কিশোর খুনের তিনটা দিন পুলিশ পার করেছে- ‘আসামি চিহ্নিত, ধরছি,’ ‘যেকোনো সময় গ্রেপ্তার’- এসব আশ্বাসে।

ইভান হত্যা মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সিএমপির উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) জসিম উদ্দিন চট্টগ্রাম খবরকে বলেন, মামলার তদন্ত বেশ অগ্রসর হয়েছে। খুনের মোটিভ স্পষ্ট, খুনিরাও চিহ্নিত। আমরা তাদের শিগগিরই আইনের আওতায় আনবো।

ওসি কোতোয়ালী জাহেদুল কবির বলেন, খুনীদের ধরতে আমাদের টিম কাজ করছে। খুব দ্রুত সময়ে আমাদের কব্জায় আসবে।

তিন দিন পার হলেও খুনিদের কেউ গ্রেপ্তার না হওয়ায় ইভানের স্বজনদের মাঝে হতাশা কাজ করছে। কারণ ইভান হত্যায় জড়িত কিশোর অপরাধী এবং ছাত্রলীগের অংশটার খুঁটির জোর আছে। খুঁটি হিসেবে সামনে আসছে একজন জনপ্রতিনিধির নাম। জামালখান এলাকায় তার শক্তিতেই যাবতীয় অপকর্ম হয় বলে দাবী খোদ পুলিশেরই।

তবে ইভানের খুনিদের না ধরতে কোনো প্রকার চাপ আছে কিনা জানতে চাইলে পুলিশ তা অস্বীকার করে আসামি দ্রুত ধরতে সচেষ্ট আছে বলে জানায়।

সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা– ছাত্রলীগ কর্মী ইভান হত্যাকারীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি নগরজুড়ে দাপিয়ে বেড়ানো কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে আরও সক্রিয় হবে পুলিশ।

আরও পড়ুন: সিনিয়র-জুনিয়র বিবাদে প্রাণ গেলো ছাত্রলীগ কর্মীর

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।