ঈদ ঘিরে চট্টগ্রামে বেড়েছে ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য

ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে চট্টগ্রাম নগরীতে বেড়েছে ছিনতাইকারী চক্রের দৌরাত্ম্য। বিশেষ করে নগরের বিআরটিসি ও সিআরবি রুটের পথচারী, স্টেশন রোড ও রিয়াজউদ্দিন বাজার কেন্দ্রিক যাতায়াতকারী গাড়ি ও পথচারীদের টার্গেট করে ছিনতাই কার্যক্রম চালাচ্ছে এ চক্রের সদস্যরা। দেশীয় অস্ত্র ছোরা, টিপ ছোরাসহ বিভিন্ন ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করে দূর দূরান্ত থেকে ঈদের শপিং করতে আসা ক্রেতাসহ সাধারণ যাত্রীদের সর্বস্ব ছিনিয়ে নিচ্ছে এ চক্র। নিরবে নগদ টাকা ও মালামাল ছিনতাই করতে না দিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করলে ধারালো অস্ত্র দিয়ে যখম করতেও ছাড়ছেনা ছিনতাইকারীরা।

গত শুক্রবার (৩১ মার্চ) রমজানের ৮ম দিনে ফয়সাল নামের এক রাজমিস্ত্রি তার গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর যাওয়ার উদ্দেশ্যে ট্রেনের টিকেট কাটার জন্য আসেন চট্টগ্রাম নতুন রেলওয়ে স্টেশনে। তিনি ফোনে কথা বলতে রেলওয়ে পার্কিং এলাকায় গেলে পড়েন ছিনতাইকারী চক্রের খপ্পরে। ছিনতাইকারীরা একপর্যায়ে রাজমিস্ত্রি ফয়সালকে ছুরিকাঘাত করে তার মোবাইলফোন ও মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। এসময় তার চিৎকারে টহলপুলিশ ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে ইমরান নামের একজনকে গ্রেপ্তার ও ছিনতাই হওয়া মোবাইলফোন ও মানিব্যাগ উদ্ধার করে। পরবর্তীতে আটক ইমরানের তথ্যমতে বাচ্চু প্রকাশ বুলেট এবং সোহাগ আব্দুল মান্নানকে সিআরবি ও স্টেশন এলাকা হতে গ্রেপ্তার করে কোতয়ালী থানা পুলিশ।

শুধু ফয়সাল নয়, এমন ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছেন অসংখ্যা সাধারণ মানুষ। দিনে দুপুরে জনবহুল স্থান থেকে টান দিয়ে মোবাইল ফোন নিয়ে উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে অহরহ। নির্জন জায়গায় পথচারীরা শিকার হচ্ছেন সংঘবদ্ধ ছিনতাইয়ের। সামনে দাঁড়িয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে সর্বস্ব কেড়ে নেওয়া হচ্ছে পথচারীদের।

গত রোববার (২ এপ্রিল) রাত ৮ টার দিকে নগরীর সিআরবি এলাকায় ঘটে যায় ঠিক এমনই এক ঘটনা। ফুটপাত ধরে হাঁটছিলেন সোহাগ বড়ুয়া নামে এক যুবক। ফুটপাতের অন্ধকার স্থানে তার পথ রোধ করে দাঁড়ায় ছিনতাইকারী চক্রের কয়েকজন সদস্য। ছোরার ভয় দেখিয়ে সব দিয়ে দিতে বললে সুযোগ বুঝে দৌড়ে আলোতে চলে আসে যুবকটি। তার পেছনে ধাওয়া করতে এসেও লোকজনের উপস্থিতি টের পেয়ে পিছু হটে অন্ধকারে মিলিয়ে যায় চক্রের সদস্যরা।

এর আগে (৩০ মার্চ) রাতের বেলায় নিউমার্কেট থেকে জুবিলী রোড, জলসা মার্কেটগামী পথচারী, নিউমার্কেট কেন্দ্রিক যাতায়াতকারী গাড়ী ও পথচারীদের টার্গেট করে ছিনতাই ও ডাকাতির প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য একত্রিত হয়ে অন্ধকার ফুটপাতে শলাপরামর্শ করার সময় ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যদের আটক করে কোতয়ালী থানা পুলিশ। পেশাদার এ ছিনতাইকারীদের কাছ থেকে ধারালো ৫টি ছোরাও উদ্ধার করা হয়।

ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে পুলিশের নিয়মতি অভিযান চললেও থেমে নেই ছিনতাই ও ছিনতাইয়ের প্রস্তুতি। সোমবার (৩ এপ্রিল) পথচারী ও গাড়ি টার্গেট করে ছিনতাইয়ের প্রস্তুতির সময় ছিনতাইকারীচক্রের আরও ৬ সদস্যকে আটক করেছে পুলিশ। পুলিশ জানায়, আটককৃতরা ঈদকে কেন্দ্র করে রাতের বেলায় ছিনতাই করার পরিকল্পনা করছিলো। বিশেষ করে নগরের বিআরটিসিগামী, সিআরবিগামী পথচারী, স্টেশন রোড ও রিয়াজউদ্দিন বাজার কেন্দ্রিক যাতায়াতকারী গাড়ি ও পথচারীদের টার্গেট ছিল তাদের।

সর্বশেষ শনিবার (৮ এপ্রিল) দেশীয় অস্ত্রসহ ছিনতাইকারী চক্রের আরও ১০ সদস্যকে আটক করে র‌্যাব। ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ঘরমুখী সাধারণ মানুষের চলাচলের স্থানে পথচারীকে আটক করে দেশীয় অস্ত্রের ভয়ভীতি দেখিয়ে মূল্যবান জিনিসপত্র, স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা-পয়সা ছিনতাই করে নিতো ছিনতাইকারী চক্রটি। শনিবার নিত্য দিনের মতো ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ছিনতাই ও ডাকাতির প্রস্তুতিকালে চক্রের ১০ সদস্যকে দেশীয় অস্ত্র ও গুলিসহ হাতেনাতে আটক করেছে র‌্যাব-৭।

র‌্যাব-৭ এর সিনিয়র সহকারী পরিচালক মো. নুরুল আবছার চট্টগ্রাম খবরকে বলেন, রমজান মাস এবং ঈদ উপলক্ষ্যে সাধারণ মানুষ নগদ টাকা নিয়ে শহরে আসেন বিভিন্ন কেনাকাটা করতে। এসব নগদ টাকা বহনকারী সাধারণ মানুষদের টার্গেট করে ছিনতাই কার্যক্রম চালায় এ চক্রের সদস্যরা। বিশেষ করে যারা ব্যক্তিগত গাড়িতে যাতায়াত করে তারা এ চক্রটির মূল টার্গেট। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায়, তাদের কাছে সীতাকুন্ড এলাকার এক ব্যবসায়ীর ব্যবসাস্থল হতে এক ব্যক্তির নগদ টাকাসহ বায়েজিদ লিংক রোড ব্যবহার করে শহরে যাওয়ার বিষয়ে তথ্য ছিলো। ওই ব্যক্তির সর্বস্ব ছিনিয়ে নেওয়ার বিষয়ে পরামর্শ ও প্রস্তুতিকালে তাদের আটক করা হয়।

এদিকে ঈদকে ঘিরে জমে ওঠা নিউমার্কেট এলাকায় আশঙ্কাজনকহারে বেড়েছে ছিনতাইয়ের ঘটনা। চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে শুরু করে নিউমার্কেট মোড, জহুর হকার ও ফুটপাত এলাকায় সমানে আধিপত্য বিস্তার করে আছে ছিনতাইকারীরা। ঈদ ঘিরে ছিনতাইকারী চক্রের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধিতে ক্রেতার পাশাপাশি চরম উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন ব্যবসায়ীরাও।

রিয়াজউদ্দিন বাজারে প্রতিষ্ঠানের জন্য মালামাল কিনতে আসা রায়হান কসমেটিকসের স্বত্বাধিকারী জিয়াদুল ইসলাম চট্টগ্রাম খবরকে বলেন, এখানে প্রতি সপ্তাহে দোকানের মাল নিতে আসি। সবসময় ভয়ে থাকি। নগদ টাকা নিয়ে মার্কেটে ঢুকতে হয়। হরহামেশাই ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে এখানে।

এদিকে নিউমার্কেট ও আশেপাশের দোকানগুলোতে ঈদের বিকিকিনি জমজমাট হয়ে উঠেছে। নিজের পছন্দ অনুযায়ী পোশাক কিনতে চট্টগ্রাম শহরসহ বিভিন্ন উপজেলা থেকে নিউমার্কেট ছুটে আসছেন লাখো মানুষ। এই সুযোগে একাধিক ছিনতাইকারী চক্র ক্রেতা ভিড়ের সুযোগ কাজে লাগিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে মুঠোফোন, স্বর্ণালঙ্কারসহ নগদ টাকা। চলন্ত বাস থেকে এ রুটে নিয়মিতই ছিনতাই হচ্ছে মোবাইল ফোন।

কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুল কবির চট্টগ্রাম খবরকে বলেন, কোতোয়ালী থানা পুলিশ সারাবছরই চুরি-ছিনতাই বন্ধে ও ছিনতাইকারী চক্র নির্মূলে অভিযান পরিচালনা করে থাকে। আসন্ন ঈদকে ঘিরে ক্রেতা নিরাত্তার কথা মাথায় রেখে নিউমার্কেট ও আশেপাশের এলাকায় বাড়তি নজরদারী বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রথম রমজান থেকে এ পর্যন্ত আমরা ১৮ জন ছিনতাইকারীচক্রের সদস্য আটক করে আদালতের মাধ্যমে তাদের কারাগারে প্রেরণ করেছি।

তিনি আরও বলেন, কোন ভুক্তভোগী ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে থানায় ডায়রি বা অভিযোগ করলে আমরা তাৎক্ষণিক মামলা রেকর্ড করি। এবং ছিনতাইকৃত মালামাল উদ্ধারে অভিযান চালাই। সম্প্রতি আমরা দুজনের মোবাইল ছিনতাই ও একজনের সোনার গহনা ছিনতাইয়ের অভিযোগ পেয়ে ছিনতাইকৃত মালামাল উদ্ধার করে ভুক্তভোগীদের বুঝিয়ে দিয়েছি।

ঈদ কেন্দ্রিক কোতয়ালী থানা ক্রেতা নিরাপত্তায় কি কি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে জানতে চাইলে ওসি জাহিদুল কবির বলেন, প্রতিদিনই আমাদের ৪টি মোবাইল টিম ও ৮টি হোন্ডা মোবাইল টিম ক্রেতা নিরাপত্তা নিশ্চিতে ২৪ ঘন্টা কাজ করে যাচ্ছে।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।