আল আমিন—দিনমজুর বাবার বড় সন্তান। দুর্গম পার্বত্য এলাকা রাঙামাটির লংগদুতে বেড়ে ওঠা এ যুবক সদ্য উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছেন। পুরো উপজেলায় একমাত্র জিপিএ-৫ পেয়েছেন আল আমিন। প্রাথমিক পর্যায় থেকে অদম্য এই শিক্ষার্থী একাডেমিক পরীক্ষার বাইরে গিয়েও সফলতা দেখিয়েছেন বিভিন্ন মেধাবৃত্তি পরীক্ষায়। পড়াশোনার বাইরে নিজেকে যুক্ত করেছেন বেশ কিছু কো-কারিকুলাম এক্টিভিটিতে। এত কিছুর পরেও মুখে হাসি নেই আল আমিনের, কোথাও যেন ভয়! শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে এতদূর আসা এই আল আমিনের ভয় সামনের উচ্চশিক্ষা নিয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিয়ে। আল আমিনের প্রশ্ন—‘কোথা থেকে জোগাড় হবে এত সবের খরচ’?
আল আমিন উপজেলার মাইনীমূখ ইউনিয়নের পূর্ব জারুল বাগান এলাকার আব্দুল করিম ও মঞ্জুরা বেগম দম্পতি সন্তান। পরিবারে তার আরও ৩ ভাই রয়েছে। সে লংগদু সরকারি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে এ সাফল্য পান। আল আমিন এর আগে রাবেতা মডেল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০২১ সালে এসএসসি পরীক্ষায়ও জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন। সে সময় এসএসসিতে উপজেলায় জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যেও এগিয়ে ছিলেন আল আমিন। এছাড়াও পিইসি এবং জেএসসিতেও তার ঝুলিতে জমা পড়েছিল জিপিএ-৫।
আল আমিনের বাবা মা সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। নিন্ম মধ্যবিত্ত পরিবারের বড় ছেলে হয়েও পড়ালেখায় এতটুকু আসতে তার শত প্রতিকূলতা কাটাতে হয়েছে অভাবের সংসারে।
আল আমিনের বাবা আব্দুল করিম জানান, ছোটবেলা থেকেই ওর পড়ালেখার প্রতি অনেক বেশি গুরুত্ব ছিল। সাধারণ দিনমজুর হয়ে সংসারের পাশাপাশি ছেলের পড়াশোনার খরচ যোগাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কোচিং এবং আনুষাঙ্গিক খরচ কিভাবে ব্যবস্থা করবো আল্লাহ ভালো জানেন।
তথ্য নিয়ে জানা যায়, অদম্য এই মেধাবী শিক্ষার্থী ২০১৪ সালে চতুর্থ শ্রেণিতে মেধাবৃত্তি পরীক্ষায় তৃতীয় স্থান অধিকার করে এবং রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের বৃত্তি পরীক্ষায়ও ট্যালেন্টপুল বৃত্তি অর্জন করেন। পরে ৫ম শ্রেণির বৃত্তি অর্জন করে ২০১৭ সালে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম’ বৃত্তি পরীক্ষায় অনন্য সেরা স্থান অর্জন করেন। একই সাথে ২০২২ সালে খাগড়াছড়ি রিজিওন কর্তৃক চীফ সার্কেল মং প্রু সেইন বৃত্তি অর্জন করেন আল আমিন। এছাড়াও নানা গুণে গুণান্বিত মেধাবী এ শিক্ষার্থী স্কুল পর্যায়ে স্কাউট, কলেজে রোবার স্কাউটসহ ক্রীড়াঙ্গন ও বিভিন্ন সৃজনশীল প্রতিযোগিতায় সরবে সফলতার সাথে ছিল তার পাদচারণ।
স্থানীয়রা জানান, একের পর এক সাফল্য এনে তাক লাগাচ্ছে পুরো উপজেলায়। অদম্য অভিপ্রায় আর কঠোর অধ্যবসায়ই আল আমিনের সাফল্যের নেপথ্য রহস্য বলে জানিয়েছেন তারা। স্কুল-কলেজ পেরিয়ে আল আমিন এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পা বাড়াবে। আল আমিনের ইচ্ছে সেনাবাহিনীর বড় অফিসার হওয়া। তবে মাঝখানটায় বিপত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে আর্থিক অনটন। সহায়তা ছাড়া আল আমিনের এই স্বপ্ন অধরাই রয়ে যাবে, এমনটাই শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তার পরিবার ও স্থানীয়রা।
আল আমিনের শিক্ষকরা বলেন, তার এমন সাফল্য একইসঙ্গে আনন্দের, অনুকরণীয় এবং ঈর্ষান্বিত। সহায়তা পেলে ভবিষ্যতে আরও ভালো করবে সে। আমরা সবসময় তার পাশে থাকবো। লংগদু সরকারি মডেল কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আজগর আলী বলেন, আল আমিন অত্যন্ত মেধাবী। শত প্রতিবন্ধকতায় থাকলেও কঠোর পরিশ্রমী। অদম্য ইচ্ছা শক্তি আর অধ্যবসায়ের ফলে সে বারবার সাফল্য ছুঁয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে সকলের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে বলে মনে করি।
মেধাবী এ শিক্ষার্থী উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের পরও মুখে নেই হাসি, কপালে হতাশার রেখা। আদৌ কি উচ্চ শিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বরাবরের মতো নিজের সেরাটা দেখিয়ে দিতে পারবে? এমনই সব হতাশাচ্ছন্ন প্রশ্ন নিজের প্রতি!
আল আমিন বলেন, সবসময়ই চেষ্টা করেছি ভালো কিছু করে দেখাতে। নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হওয়ার অন্যান্য আট দশটা ছেলের মতো সবকিছু নিজের মতো করে পাইনি। তবুও আমার এ ফলাফলের জন্য আনন্দিত। জানি না পরবর্তী সময়ে আমার জন্য কি অপেক্ষা করছে। তবে আমার ইচ্ছে সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে সেনাবাহিনীর বড় অফিসার হবো। তবে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোচিং ও ভর্তি সংক্রান্ত বিষয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছি।
এদিকে আল আমিনের ধারাবাহিক সাফল্যে স্কুল-কলেজের শিক্ষক, সহপাঠী, স্থানীয়রা এবং পরিবারের সদস্যরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, একটু সহায়তা পেলে আল আমিন আরও এগিয়ে যাবে।
মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।