চট্টগ্রাম নগরীর ৪১ টি ওয়ার্ডে ৫ মিলিয়নের বেশি বাসিন্দা বছরে ২ লাখ ৫৭ হাজার ৯১৩ মেট্রিক টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন করে। যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাবে যার ৭০ হাজার ৮৩৩ মেট্রিক টন প্লাস্টিক বর্জ্য নালা প্লাস্টিক বর্জ্য নালা, নর্দমা, খাল এবং জলাশয়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টির পাশাপাশি কর্ণফুলি নদীতে ভয়ংকর দূষণ সৃষ্টি করছে। যা মোট উৎপাদিত বর্জ্যের আনুমানিক ২৭ শতাংশ। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্ণফুলি নদীতে ২-৭ মিটার পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্যের স্বর সনাক্ত করেছে যা ড্রেজিংয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) সমুদ্র বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, অর্থনীতি বিভাগ, এবং মার্কেটিং বিভাগের একদল গবেষক বিশ্বব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় একটি গবেষণা পরিচালনা করেন। এ গবেষণায় উক্ত বিষয়টি উঠে আসে। Plastic Free Rivers and Seas for South Asia (PLEASE) প্রকল্পের আওতায় United Nations Office for Project Services (UNOPS) এবং South Asia Cooperative Environment Programme (SACEP) এর তত্ত্ববাবধানে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মোট ৪১টি ওয়ার্ডে এ গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
এ প্রকল্পের অধীনে মঙ্গলবার (৬ মে) নগরীর রেডিসন ব্লু হোটেলে ‘MULTI-STAKEHOLDER CONSULTATION WORKSHOP ON PLASTIC WASTE MANAGEMENT IN CHATTOGRAM CITY’ শীর্ষক একটি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে। কর্মশালায় বক্তা ও প্রশিক্ষকরা গবেষণাটির বিষয়ে আলোকপাত করেন।
গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে জানা যায়, চট্টগ্রাম নগরীর ৪১ টি ওয়ার্ডে ৫ মিলিয়নের বেশি বাসিন্দা বছরে ২ লাখ ৫৭ হাজার ৯১৩ মেট্রিক টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন করে। অপরদিকে ২০ হাজার ৫০২ জন শ্রমিক ও উদ্যেক্তা প্রতি বছর ১ লাখ ৮৭ হাজার ৭৯ মেট্রিক টন (মোট উৎপাদনের আনুমানিক ৭৩%) প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ এবং রিসাইক্লিং করে নানাবিধ পন্য তৈরীতে অবদান রাখছে। এ সকল প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহে সক্ষমতা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে, ভাঙারি, টোকাই এবং সিটি করপোরেশনের ময়লা সংগ্রাহকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে পিপিই, হ্যান্ডগ্লাভস, মাস্ক ও বুটজুতা। যেখানে বিশ্বে প্লাস্টিক বর্জ্য রিসাইক্লিং এর পরিমান ৯-১৬ শতাংশ সেখানে ৭৩ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ এবং রিসাইক্লিং করার মাধ্যমে চট্টগ্রাম নগরী সারা বিশ্বে একটি রোল মডেলে পরিণত হয়েছে।
গবেষণা বলছে, জেলেদের মাছ ধরার কাজে ব্যবহৃত প্লাস্টিক জাল পড়ে থাকে সমুদ্রের তলদেশে, যা ভূতুরে জাল হিসেবে বাংলাদেশ উপকূলে পরিবেশ বিপর্যয় ঘাটাচ্ছে এবং তা ধীরে ধীরে ভেঙে তৈরি হচ্ছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। সে প্লাস্টিক কণা মাছের মাধ্যেমে পৌঁছে যাচ্ছে খাবারের টেবিলে। এসব মাইক্রোপ্লাস্টিক মানব শরীরে ক্যান্সার, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা, বন্ধ্যাত্ব ও অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হতে পারে।
গবেষণা থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশের উপকূলীয় এবং সামুদ্রিক এলাকায় প্রায় ১৯ হাজার নৌকা ও ট্রলার বছরে ৪০ হাজার ১১০ মেট্রিক টন প্লাস্টিকের জাল ও অন্যান্য সরঞ্জাম ব্যবহার করে থাকে, যার মধ্যে ২ হাজার ৭৪০ মেট্রিক টন (আনুমানিক ৭%) সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয় বা পরিত্যক্ত হয়। মাছ ধরার পরিত্যক্ত জাল ‘ঘোস্ট ফিশিং’ বা ভূতুড়ে মাৎস্য ফাঁদ হিসাবে সামুদ্রিক প্রাণীদের মৃত্যু ঘটাচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাছাড়া গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদী প্রতিদিন ১-৩ বিলিয়ন মাইক্রোপ্লাস্টিক বহন করছে বঙ্গোপসাগরে, যা সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
মঙ্গলবার (৬ মে) অনুষ্ঠিত কর্মশালায় গবেষকরা জানিয়েছেন, প্রকল্পের আওতায় একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব পণ্যে তৈরি ও বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে নানা নতুন উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণ শেষে তারা পরিবেশবান্ধব কাগজের কলম, সুপারি পাতার তৈরী বিভিন্ন ধরনের বাটি, চামচ ও নানা উপকরণ, ফুডগ্রেড কাগজের তৈরী কাপ ইত্যাদি তৈরি করছেন। এবং তা বিক্রি করে তারা যেমন আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন, তেমনি প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণে অবদান রাখছেন। এই প্রকল্পের আওতায় একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন সুপারশপে, ফুডকোর্ট, ট্যুরিস্ট এলাকার খাবারের দোকান সমূহে প্রায়, ২০ হাজার সেট পরিবেশবান্ধব কাটলারী বিতরণ করা হয়েছে।
কর্মশালায় উপস্থিত ছিলেন প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এস. এম নসরুল কদির, মেরিন সায়েন্সেস এন্ড ফিশারিজ অনুষদের ডিন ড. মো. শাহাদাত হোসেন, মার্কেটিং বিভাগের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আলমগীর, ফিশারিজ বিভাগের চেয়ারম্যান ড. আশরাফুল আজম খান, অর্থনীতি বিভাগের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আলাউদ্দিন মজুমদার, মেরিন সায়েন্সেস ইন্সটিটিউটের প্রফেসর ড. এস এম শরিফুজ্জামান, ড. এম শাহ নেওয়াজ চৌধুরী, ইশতিয়াক আহমেদ চৌধুরী।
এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম ও প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা কমান্ডার ইখতিয়ার উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী
মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।