চট্টগ্রাম-যশোরে মানব পাচারের বিশাল চক্র, টার্গেটে পোশাক শ্রমিকরা

চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি থেকে শুরু করে যশোর জেলার বেনাপোল পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছে নারী পোশাক শ্রমিক পাচারের একটি অসাধু চক্র। উচ্চ বেতনের প্রলোভন দিয়ে এসব নারীদের ভারতে পাচার করে বিক্রি করে দেওয়া হতো পতিতালয়ে। তারপর চাইলেও সেখান থেকে আর বেরিয়ে আসা সম্ভব হয় না।

সম্প্রতি এই চক্রের প্রলোভনে পড়ে ভারতের পতিতালয়ে বিক্রি হওয়া একজন নারী ভুক্তভোগী পালিয়ে আসার পর তার লোমহর্ষক বর্ণনায় বেরিয়ে আসে নারী পাচার চক্রের ভয়াবহ সিন্ডিকেটের এসব কথা। ভুক্তভোগীর দেওয়া তথ্য মোতাবেক চক্রের বেশ কিছু দালাল এবং সীমান্ত পারাপার করতে সহায়তা করা লাইনম্যান শনাক্ত করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) চট্টগ্রামে থাকা এই চক্রের ২ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব-৭ । গত ২৪ জুন এক ভুক্তভোগীর দায়ের করা মামলায় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন—বাঁশখালীর জালিয়াপাড়া এলাকার মো. তারেকের স্ত্রী ঝুমু (৩০) এবং হাটহাজারীর বালুচড়া এলাকার পারভিন আক্তার (২৫)। তাদের দু’জনকেই বালুচড়া এলাকার নতুনপাড়া সিএনজি স্টেশন থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এর আগে, গত ২৪ জুন মামলার ১ নম্বর আসামি মো. তারেকে গ্রেপ্তার করে বায়েজিদ বোস্তামী থানা পুলিশ।

গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের বরাত দিয়ে র‌্যাব জানায়, তারা পরস্পর যোগসাজশে দীর্ঘদিন যাবৎ বিভিন্ন গার্মেন্টস কারখানার নারী শ্রমিকদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলে বেশি বেতনে চাকুরীর প্রলোভন দেখিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পাচার করে আসছিলো।

র‌্যাব-৭ এর সিনিয়র সহকারী পরিচালক (গণমাধ্যম) মো. শরীফ-উল-আলম জানান, গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের সংক্রান্তে পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তাদেরকে চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।

যা ঘটেছে ভুক্তভোগীর সাথে

পালিয়ে আসা ওই তরুণীর করা মামলার অভিযোগে বলা হয়, তিনি রংপুর থেকে চট্টগ্রামে পোশাক কারখানায় চাকরি করতে আসেন। তার বান্ধবীর বাড়ি চাঁদপুরে। গত এপ্রিলে তারা চাকরি ছেড়ে দেন।

চাকরি ছাড়ার পর নতুন চাকরি খোঁজার সময় তাদের পূর্ব পরিচিত পারভীনের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। এ সময় তিনি মাসিক ৪০ হাজার টাকা বেতনে তাদের ভারতের রাচীতে চাকরির কথা বলে তারেকের স্ত্রী ঝুমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন।

ওই তরুণী অভিযোগ করেন, গত ২৯ মে রাতে তারেক, তার স্ত্রী ঝুমা ও পারভীন মিলে তাদের বাসে করে যশোর নিয়ে যান, সেখান থেকে অবৈধভাবে ভারতে নিয়ে যান।

মামলায় ভারতে এবং দেশে বিভিন্ন দালাল ও ভারতের রাচীতে নিয়ে হোটেলে আটকে রেখে দেহ ব্যবসায় বাধ্য করার অভিযোগ করা হয়। পাশাপাশি কীভাবে পালিয়ে এসেছে এবং অবৈধভাবে ভারতে যাওয়ার বর্ণনাও রয়েছে মামলায়।

ফিরতে পারেনি ভুক্তভোগীর বান্ধবী

বায়েজিদ বোস্তামী থানার ওসি সঞ্জয় সিনহা গণমাধ্যমকে বলেন, চট্টগ্রাম নগরীতে পোশাক কারখানায় চাকরি করা দুই তরুণীকে ভারতের রাচীতে বিউটি পার্লারে চাকরির কথা বলে পাচার করে তারেক ও তার সহযোগীরা।

দেশে ফিরে আসা তরুণীর সঙ্গে কথা বলে পুলিশ জানতে পারে, গত ২৯ মে দুই তরুণীকে যশোর হয়ে ভারতে নিয়ে যায় তারেক। সেখান থেকে এক তারুণী স্থানীয় এক নারীর সহযোগিতায় গত ৬ জুন দেশে ফিরে আসেন।

চট্টগ্রামের বাঁশখালীর বাসিন্দা তারেক চট্টগ্রামে বিভিন্ন ডিজে পার্টিতে নাচ-গান করার সুবাদে পাচারকারী চক্রের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয় বলে গ্রেপ্তারের পর তারেক পুলিশকে এ কথা বলেছেন।

ওসি বলেন, তারেকের স্ত্রী ঝুমা আক্তার পাচারকারী চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার কাজ করতেন এবং তার অপর সহযোগী পারভীন বিভিন্ন পোশাক কারখানায় চাকরি করে তরুণীদের ভারতে যাওয়ার জন্য প্রলুদ্ধ করতেন।

ওসি সঞ্জয় সিনহা বলেন, অভিযোগকারী তরুণী দেশে ফিরতে পারলেও তার বান্ধবী আসতে পারেননি। এ চক্রের সঙ্গে নারীসহ দুই দেশের বেশ কয়েকজন দালাল জড়িত বলে জানতে পেরেছে বায়েজিদ বোস্তামী থানা।

সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “আমাদের কাছের লোকজন অনেক সময় বেইমানি করে, যার কারণে মানুষের প্রতি মানুষ বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে। সম্প্রতি আমাদের দেশের সীমান্তে কিছু অস্থিরতা দেখা গেছে। অপহরণকারী ও পাচারকারীরা অনেক বেশি সক্রিয়। এসব বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সব ইউনিটকে সতর্ক থাকতে হবে এবং অপহরণকারী ও পাচারকারীদের ফাঁদে যাতে কেউ পা না দেয়, সে জন্য সবাইকে সামাজিক ও পারিবারিকভাবে সচেতন হতে হবে।”

প্রসঙ্গত, মানব পাচারের রুটগুলোর মধ্যে অন্যতম যশোর সীমান্ত। এই সীমান্তসহ অন্যান্য সীমান্ত ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় বেশ কয়েকটি মানব পাচার চক্রের আস্তানা গড়ে উঠেছে। গোয়েন্দাদের ব্যাপক তৎপরতায় রাজধানী এবং নগর-মহানগর থেকে পালিয়ে সীমান্ত ও সীমান্তবর্তী এলাকায় ঘাঁটি গেড়েছে মানব পাচারকারীরা।গত ফেব্রুয়ারিতে গোয়েন্দা বাহিনীর বিশেষ প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে আসে বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচার হয়েছে। তাছাড়া যশোর সীমান্ত দিয়ে মানব পাচারের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। যে চক্র ছড়িয়ে গেছে চট্টগ্রামেও!

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।