চবির হলে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে আসন বরাদ্দ—ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা

মঙ্গলবার (৯ আগস্ট) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) চালু হওয়া ছাত্রীদের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে আসন বরাদ্দে সাম্প্রদায়িকতার আশ্রয় নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। হলটিতে ৬০ শতাংশ আসনই বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ও অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য। বাকি ৪০ শতাংশ আসন অন্যান্য ছাত্রীদের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

ধর্মকে কেন্দ্র করে আসন বরাদ্দ দেয়ার এমন সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষার্থীরা জানান, ক্যাম্পাসে কোথাও তো মুসলিম ও হিন্দুদের জন্য আলাদা হল নেই। সব হলেই তো হিন্দু, মুসলিম বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সকলে সহাবস্থান করছে। কোথাও কখনো কোনো ঝামেলা হয়নি। তাহলে এসময়ে এসে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জন্য সংখ্যা গরিষ্ঠ আসন বরাদ্দ রাখার যৌক্তিকতা কী?

শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন—অন্যান্য হলে যেহেতু সকলে সহাবস্থান করতে পারতেছে তাহলে এই হলে সমস্যা কোথায়? তাদের দাবি—অন্যান্য হলে যেহেতু সকলেই সমান অধিকার পাচ্ছে সেখানে এই ফলে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন দেয়ার মাধ্যমে অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সাথে অন্যায় করা হয়েছে।

শামসুন্নাহার হলের আবাসিক শিক্ষার্থী নিশাত তাসনিম রিফা বলেন—মুক্ত বিশ্বদ্যালয়ে সবারই একটা সামাজিকীকরণের ব্যাপার আছে। ওদেরকে আলাদা করে দেয়া হলে সামাজিক একতাটা নষ্ট হবে। একে অপরের সাথে বন্ডিং কমে যাবে। তখন দেখা যাবে, তারা আমাদের সাথে মিশবে না, আর আমরাও তাদের সাথে মিশবো না। তাছাড়া, অন্যান্য হল থেকেও নাকি তারা ওই হলে চলে যাবে। তাহলে সামাজিক বিচ্ছিন্নতাটা আরও প্রকট হবে। ধীরে ধীরে দূরত্বটা বাড়তেই থাকবে। তাই, আমার মতে আলাদা না করে বরং আগের মতো সবাইকে একসাথে মিলেমিশে থাকার সুযোগ করে দেয়া হোক।

এদিকে আসন বরাদ্দে ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের প্রতিবাদে বুধবার (৯ আগস্ট) বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে চবিস্থ পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র পরিষদ। সংগঠনটির সভাপতি আল আমিন বলেন—বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলায় নির্দিষ্ট ১ শতাংশ ক্ষুদ্র-নৃ গোষ্ঠী জনগোষ্ঠীর জন্য ৬০ শতাংশ আসন বরাদ্দ করে বাকি ৯৯ শতাংশ ছাত্রীদের জন্য ৪০ শতাংশ আসন বরাদ্দ দেওয়া পাকিস্তান সরকারের বিভাজন নীতিকেই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ সুষ্ঠু রাখার জন্য অনতিবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর সাম্প্রদায়িক সিদ্ধান্ত বাতিল করবে বলে আশা করছি।

এছাডাও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দও কর্তৃপক্ষের এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছেন ।

শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি প্রদীপ চক্রবর্তী দুর্জয় বলেন, আমরা সবসময় বলি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। কিন্তু অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে কেন এভাবে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে বিভাজন করা হবে? এতদিন বিভিন্ন হলে সকল ধর্মের ছাত্র এবং ছাত্রীরা মিলেমিশে ছিল। কখনো তো কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু এখন এসে একটি হলে নির্দিষ্ট একটা ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে আসন বরাদ্দ দেয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়। এতে করে আমাদের মধ্যে যে ধর্মীয় সম্প্রীতিটা আছে তা অনেকটাই নষ্ট হয়ে যাবে বলে আমি মনে করি। প্রয়োজনে তাদের জন্য একটা নির্দিষ্ট কোটা রাখতে পারে, কিন্তু সেটা ৬০ শতাংশ দেয়টা কোনোভাবেই উচিত হয়নি।

তিনি আরও বলেন, আমরা ছাত্রলীগের সহযোদ্ধাদের সাথে নিয়ে এবিষয়ে ভিসি ম্যাডামের নিকট দাবি জানাব যাতে অন্যান্য হলের মতো এই হলেও একইভাবে আসন বরাদ্দ দেয়া হয়। তাছাড়া সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে যদি এ নিয়ে কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় তাহলে আমরা তাতে একাত্মতা পোষণ করব।

সহ-সভাপতি ফাল্গুনী দাশ বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা অধিকাংশই পাহাড়ি। তাদের আমাদের চলাফেরা ও সংস্কৃতির ভিন্নতা আছে। কিন্তু আমরা যখন একসাথে মিলেমিশে থাকবো তখন একজন অপরজনকে বুঝতে পারবো, জানতে পারবো। বিপরীতে তারা যখন আলাদা হয়ে যাবে তখন তাদেরকেও আমরা বুঝতে পারবো না আর তারাও আমাদেরকে বুঝতে পারবে না। তখন দেখা যাবে আরও নতুন নতুন সমস্যা তৈরি হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, এভাবে বিভাজন করাটা ঠিক না। কেননা, অদূর ভবিষ্যতে এটি থেকে অনেক বড় সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। তবে, যেহেতু এটি একটি সাম্প্রদায়িক ইস্যু, সেহেতু সকল ছাত্র, শিক্ষক, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা এক সাথে বসে এর একটি সমাধান খোঁজা দরকার।

শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকরাও কর্তৃপক্ষের এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আব্দুল হক বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়েই দেশ স্বাধীন করেছিলেন। এবং জননেত্রী শেখ হাসিনা এ মূলনীতিকে ধারণ করেই দেশ ও জাতির ভাগ্য উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মীয় দিক বিবেচনা করে যে আসন বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে এটা বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার অসাম্প্রদায়িক নীতির বিরুদ্ধে বলে আমি মনে করি।

তিনি আরো বলেন, আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশের সব ধর্মের মানুষই নিজের ভেতর অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালন করে। কিন্তু সে জায়গায় এভাবে আসন বরাদ্দ দেয়ার ফলে শিক্ষার্থীদের মনে সাম্প্রদায়িকতার যে বীজ তা ডালপালা মেলতে শুরু করবে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. উদিতি দাশ বলেন, জননেত্রী শেখ হাসিনার সার্বিক তত্ত্বাবধানে ও অর্থায়নে হলটি তৈরি করা হয়েছে। এখানে চীন সরকারও অর্থায়ন করেছে বলে আমি শুনেছি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের উপর ভিত্তি করেই যারা আদিবাসী, নৃগোষ্ঠী এবং যারা পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠী, তাদের জন্য ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য শুধু ৬০ শতাংশ সিট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। অন্যরা বাকি সিটগুলো পাবে।

তিনি আরও বলেন, হলটিতে শতভাগ আসনই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তা পরিবর্তন করা হয়েছে৷ কারণ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তো শুধু একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য আলাদা একটি হল থাকতে পারে না।

এ বিষয়ে জানার জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা তিনি ফোন কেটে দেন।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।