চীনের সাফল্যের নেপথ্যে স্কলারদের মূল্যায়ন

জ্ঞান, গবেষণা, প্রযুক্তি, শিক্ষা, স্থাপনা—সব দিক দিয়ে চীন আজ বিশ্বের প্রথম সারির একটা দেশ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সড়ক, সেতু, উড়ালপথসহ বড় বড় সব স্থাপনা নির্মাণের পেছনে অবদান রাখছে দেশটির বিশেষজ্ঞরা৷ আর এর ফলে অর্থনৈতিকভাবেও বেশ সমৃদ্ধ দেশটি। তবে ৯০ এর দশকের সময়টায় চীনের অর্থনীতিও বেশ সচল ছিলো না।

মূলত ১৯৯০ সালের পর দেশটির সরকার বিশেষ নজর দেয় গবেষণার ওপর। তখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত স্কলারদের আমন্ত্রণ জানানো হয় দেশে। দেওয়া হয় পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা। আর তখন থেকে দিনে দিনে অর্জন আর সাফল্যে সব দিক দিয়ে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠে চীন।

বর্তমানে চীন পৃথিবীকে নেতৃত্ব দিতে শুরু করেছে একদম সামনের সারি থেকে। প্রযুক্তি, শিক্ষা, গবেষণা সব বিষয়ে চীন উন্নত। চীন বাংলাদেশের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ এবং ঘনিষ্ঠ। বাংলাদেশের অনেক উল্লেখযোগ্য উন্নয়নের সহযাত্রী এই চীন।
রাস্তা, সেতু, উড়ালপথ, এয়ারপোর্টসহ নানান সেক্টরে শত শত প্রজেক্ট ডিজাইন এবং বাস্তবায়ন করছে চীনের অনেক কোম্পানি। অথচ আজকে থেকে ৩০-৪০ বছর আগেও চীনের উন্নয়ন ছিল খুবই কম। তারা বড় বড় অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য উন্নত দেশের উপর নির্ভর করত। তবে আজকের বিশ্বে বেল্ট এবং রোড প্রজেক্টের আওতায় চীন পৃথিবীর নানা জায়গায় চালিয়ে যাচ্ছে নির্মাণ কাজ।

চীনের এই অভূতপূর্ব উন্নয়নের পিছনে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টা কাজ করেছে তা হলো স্কলারদের মূল্যায়ন এবং শিক্ষা। শিক্ষা যে কোনো দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। গ্লোবাল পার্টনারশিপ অনুসারে শিক্ষাকে একটি মানবাধিকার হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এটি মানব, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

১৯৯০ সালের আগে চীনের অর্থনৈতিক অবস্থা আজকের মত উন্নত ছিল না। যে সকল ট্যালেন্ট এবং দক্ষ চীনা নাগরিক বিদেশে পড়তে যেত তাদের অনেকেই চীনে ফিরে আসত না৷ এর পেছনে ছিলো পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধার অভাব। ১৯৯০ সালে চীনা স্কলাররা দেশে ফিরে আসার হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেলে চীনা সরকার সচেতন হয়ে উঠে এবং নানা রকম সুযোগ সুবিধা তৈরি করা শুরু করে।

‘দ্যা থাউজ্যান্ট ট্যালেন্ট প্রোগ্রাম’ এই পলিসির একটা অংশ। তখন সরকার নিজ দেশেই বিশ্বমানের গবেষণা এবং অন্যান্য স্কিল বেইজ পেশা খোলা শুরু করে। বিদেশে কাজ করা স্কলারদের সরকারিভাবে দাওয়াত দেয়া শুরু হয়।দেওয়া হয় অন্যদেশের থেকে বেশি সুযোগ সুবিধা। বিশেষ সম্মানও মিলতো বিদেশ ফেরত গুণী মানুষদের। নেতৃত্ব দেয়ার জন্য তৈরি করে দেয়া হয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। বিদেশে কাজ ছেড়ে দেশে এসেছে শুনলেই মানুষ সম্মান দেখায় এখানে। দেশের ডাক পেয়ে ছুঁটে আসা শুরু করল হাজার হাজার চাইনিজ স্কলার। বিশ্বের নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে এমন কি নাসা থেকেও ছুঁটে আসল অনেক নামিদামি গবেষক, শিক্ষক, খেলোয়াড়সহ নানা পেশার মানুষ৷

তারপর দেশেই গড়ে তুলল— ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়, পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়, ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিশ্বমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পৃথিবীর সব থেকে বড় টেলিস্কোপ, পৃথিবীর সব থেকে বড় ব্রীজ, পৃথিবীর সব থেকে বড় জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র— আরও কত রকমের রেকর্ড একে একে গড়তে শুরু করে এই দেশের মানুষ৷

পুরো বিশ্ব আজ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে এই দেশটির দিকে। শত শত শহরকে আধুনিক এবং অত্যাধুনিক টেকনোলজি দিয়ে সাজিয়ে তুলছে প্রতিদিন। ২০২০ সালের সামার অলিম্পিকে ৩৮টা সোনা ৩২টা সিলভার এবং ১৮টা ব্রোঞ্জ পেয়েছে চীন। যেখানে ১৯৮৮ সালে কেবল মাত্র ৫টা সোনা জিতেছিলো চীন।

অগ্রগতির ছোঁয়া লেগেছে চীনের প্রত্যোকটা খাতে। চীনের এই বিশাল অগ্রযাত্রায় ভূমিকা রেখেছে এই দেশের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা এবং একদল বিদেশ ফেরত চীনা স্কলার। তবে দুঃখের বিষয় হলো— বাংলাদেশে কেউ নিজে থেকে ফিরে আসলে মনে করা হয় বিদেশে নিজে কিছু করতে পারেনি তাই ফিরে এসেছে। বাংলাদেশের অসংখ্য দক্ষ মানুষ অন্য দেশের উন্নয়নের জন্য কাজ করে। অথচ অপার সম্ভাবনা থাকা সত্বেও তাদের নিজ দেশের জন্য কাজ করার সুযোগ নেই।

আমার চীনে অবস্থানের সময়কাল ৬ বছর। এই সময়ে এই দেশের মানুষের সাথে, ভাষায় সাথে এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক উপাদানের সাথে একটা গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। যে সময়ে আমি চীনে এসেছি এটি চীনের ইতিহাসের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সময়। আমার জন্যও সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। কারণ— এখানে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া শুরু করেছি।

আশা করছি বাংলাদেশেও স্কলারদের জন্য সুযোগ তৈরি হবে। দেওয়া হবে সঠিক মূল্যায়ন। আর এমনটা ঘটলে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছাতে বেশি দিন লাগবে না আমাদেরও।

লেখক: পিএইচডি গবেষক, ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়, চীন।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।