২ সন্তান আর মা-বাবা, স্ত্রী নিয়ে মাঝারি পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তি জেলে পাড়ার বাসিন্দা সুখেন দাশ। কাপ্তাই হ্রদের জলে জালের খেলায় মাছ আহরণে চলে তার সংসার।নিষেধাজ্ঞার কারণে দীর্ঘদিন কাজ না থাকায় পড়তে হয়েছে অর্থাভাবে। অবশেষে মাছ ধরা শুরু হওয়ায় হাসি ফুটেছে সুখেনের মুখে।
সুখেনের মতো এমন অসংখ্য জেলে স্বপ্ন দেখেন কাপ্তাই হ্রদ ঘিরে। হ্রদ ঘিরে যেমন তাদের বসবাস তেমনি হ্রদের পানিতেই জুটে তাদের আহার, মিটে শখের কিছু অংশ। নিষেধাজ্ঞা পেরিয়ে কাপ্তাই হ্রদে মাছ শিকার শুরু হওয়ায় কিছুটা অস্বস্তিতে থাকা জেলেদের জীবনে ফিরেছে স্বস্তি, প্রাণচাঞ্চল্য।
মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) সরজমিনে কাপ্তাই ফিসারি ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, কেউ বরফ ভাঙছেন, কেউ ট্রাকে মাছ তুলছেন৷ আবার আরেকদল মাছগুলো সারিবদ্ধভাবে রাখছেন। ব্যবসায়ী ও শ্রমিকের হাঁকডাকে মুখর হয়ে উঠেছে অবতরণ কেন্দ্র।
শুধু অবতরণ কেন্দ্রই নয়, পুরো ফিসারিঘাট জুড়েই চলছে এমন কর্মযজ্ঞ। অবতরণকৃত মাছের রাজস্ব মিটিয়ে বরফ দিয়ে প্যাকিংয়ে ব্যস্ত শ্রমিক। সেই মাছ ট্রাকযোগে চলে যাচ্ছে রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায়। প্রথম দিনে চাপিলা ও কাচকি মাছের আধিক্য থাকলেও দেখা মিলেনি কার্প জাতীয় মাছের।
জেলার মনসুর মিয়া বলেন, দীর্ঘ চারমাস পর লেকে জাল ফেললাম। প্রথম জালে মলা, চাপিলা এবং কেচকি মাছ উঠেছে। এতদিনের বিরতি শেষে আবারও কাজে ফিরতে পেরে ভালো লাগছে। আগামী ৯ মাস আমরা লেকে মাছ ধরতে পারবো।
জেলে বাদল দাস বলেন, হ্রদে প্রচুর পানি ও স্রোত থাকায় জাল টানা যাচ্ছে না। পানি স্থির না হওয়া পর্যন্ত জালে মাছ আসবে কম।
তবু দীর্ঘদিন পর জাল নিয়ে হ্রদে নামতে পারায় আমরা সবাই খুশি। তিনি আরও বলেন,বন্ধকালীন বেকার সময় কেটেছে। পরিবার নিয়ে কষ্টে ছিলাম। আশা করি জালে মাছ আসবে। আমাদের কষ্ট দূর হবে।
আরেক জেলে বাঁধন দাস জানান, পানি কিছুটা কমে এলে জালে মাছ আসবে। অন্যান্য বছর প্রথম দিন প্রতি খোপে পাঁচ থেকে ছয় ড্রাম মাছ পেতাম। এ বছর ১০ থেকে ১২ কেজির বেশি মাছ পাওয়া যাচ্ছে না।
কয়েকজন জেলে জানান, অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার কাপ্তাই হ্রদের আইড় মাছের আহরণ ও আকার বেড়েছে। তবে বিশেষ করে কেচকি ও চাপিলা মাছ ছোট পাওয়া যাচ্ছে। অন্য বছরের চেয়ে এবার কাপ্তাই হ্রদে পানি অনেকটা বেশি। যে কারণে জেলেরা যেসব জায়গায় জাল ফেলে থাকেন সেখানে ওই পরিমাণ মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। বৃষ্টিপাত ও ঢলের কারণে হ্রদের পানি ঘোলা হওয়ার কারণে মাছ পর্যাপ্ত খাবার না পেয়ে বাড়তে পারেনি।
চাঁদাবাজির কারণে মাছ আহরণে ভাটা
কাপ্তাই হ্রদে জেলেরা মাছ আহরণে শুরু করলেও পাহাড়ের একটি আঞ্চলিক দলের সদস্যদের চাঁদা দিতে না পারায় জেলেদের মাছ শিকার করতে নিষেধ করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ফলে অনেক জেলেই নিষেধাজ্ঞা শেষ হলেও মাছ ধরেননি। তাই মাছ আহরণও হচ্ছে তাই কম।
কয়েকজন মৎস্য ব্যবসায়ী বলছেন, প্রতি বছর চাঁদা দিয়ে হ্রদ থেকে মাছ আহরণ করতে হয়। এ বছর অতিরিক্ত চাঁদা দাবি করায় তা দেওয়া সম্ভব হয়নি। তাই জেলেদের মাছ ধরতে দিচ্ছে না সংগঠনটির সশস্ত্র সদস্যরা।
কাপ্তাই লেকে চাঁদাবাজির কথা স্বীকার করে রাঙামাটির পুলিশ সুপার মো. মীর আবু তৌহিদ বলেন, ‘আমরা শুনেছি, এখনো কেউ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দেয়নি। অভিযোগ পেলে এখানকার অন্যান্য প্রশাসনের সঙ্গে এসব দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) রাঙামাটি বিপণনকেন্দ্রের ব্যবস্থাপক কমান্ডার আশরাফুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, জেলেদের মাঝে আশঙ্কা থাকায় মাছের অবতরণ কম।
কাপ্তাই হ্রদ বৃহত্তর মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুস শুক্কুর বলেন, কাপ্তাই হ্রদে জেলেদের মাছ ধরায় একাধিক আঞ্চলিক দলের চাঁদাবাজির কথা স্বীকার করেন।
তিনি বলেন, এসব বিষয় আমরা স্থানীয় প্রশাসনকে জানিয়েছি। প্রশাসন কী করে দেখি।
প্রসঙ্গত, ১৯৫৬ সালে রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলায় কর্ণফুলী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের লক্ষে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ১৯৬২ সালে বাঁধ নির্মাণ শেষে রাঙামাটির বিশাল এলাকা জুড়ে সৃষ্টি হয় কৃত্রিম জলাধার কাপ্তাই হ্রদ। এই হ্রদই বর্তমানে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয়সমূহের মধ্যে সর্ববৃহৎ। এর আয়তন প্রায় ৬৮ হাজার ৮০০ হেক্টর। যা বাংলাদেশের পুকুরসমূহের মোট জলাশয়ের প্রায় ৩২ শতাংশ এবং অভ্যন্তরীণ মোট জলাশয়ের প্রায় ১৯ শতাংশ।
১৯৬১ সালে রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে কর্ণফুলী জলবিদ্যুৎকেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষে এ হ্রদের সৃষ্টি হলেও এটি রাঙামাটিতে মৎস্য উৎপাদন ও স্থানীয় জনসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রেখে আসছে। এ হ্রদের মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন কয়েক হাজার জেলে।
জেলে ও ব্যবসায়ীদের মতে, কাপ্তাই হ্রদের পাঁচটি চ্যানেলে মাছ উৎপাদন হলেও বর্তমানে লংগদুর কাট্টলী-মাইনি চ্যানেলে মাছের উৎপাদন হচ্ছে। তবে অন্য চারটি চ্যানেলে মাছের উৎপাদন তুলনামূলকভাবে কম। যার মধ্যে বর্তমানে চেঙ্গী নদী আর রাইংখ্যং নদীর চ্যানেলে প্রজনন ক্ষেত্রগুলো প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে।
নদীর তলদেশ ভরাট আর নদীর প্রবাহ কমায় এ অবস্থার সৃষ্টি। অন্যদিকে কাচালং নদী, মাইনি নদীর সংযোগ এলাকায় এবং কর্নফুলী নদীর বরকল এলাকার জগন্নাথছড়া এলাকায় প্রজনন ক্ষেত্রগুলোতে কিছু সংখ্যক রুই জাতীয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন হলেও সেগুলো এখন নষ্ট হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ হিসেবে অবশ্য তারা কাপ্তাই হ্রদের তলদেশ ভরাটকে দায়ী করছেন।
কার্প জাতীয় মাছের বংশবিস্তারের লক্ষ্যে প্রতি বছর ১ মে থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত হ্রদে মাছ শিকার বন্ধ থাকে। তবে এ বছর কাপ্তাই হ্রদে পর্যাপ্ত পানির অভাবে মাছের বংশবিস্তার সুষ্ঠুভাবে না হওয়ায় নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ দুই দফা বাড়ানো হয়। এতে চার মাস সাত দিন বিরতির পর হ্রদে মাছ আহরণে নামেন জেলেরা।
মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।