গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিপাতে রাঙামাটি জেলার কাপ্তাইয়ে জনজীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। কাপ্তাইয়ের বেশ কিছু এলাকায় টানা বর্ষণে পাহাড় ধস ও গাছ পড়ে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। আবার কিছু নিম্নাঞ্চলে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। টানা বর্ষণে পাহাড় ধসের আতঙ্ক বিরাজ করছে জনমনে।
সোমবার (৭ আগস্ট) কাপ্তাই উপজেলার বেশ কিছু এলাকায় গিয়ে টানা বর্ষণে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র দেখা গেছে। এছাড়া কাপ্তাইয়ের প্রধান সড়কেই বিশাল বড় বড় গাছ পড়ে এবং পাহাড় ধসে সড়কের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে ইতিমধ্যে সড়ক যোগাযোগ স্বাভাবিক রাখতে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর রাঙামাটির বিভিন্ন জায়গায় মাটি অপসারণে কাজ করতে দেখা গেছে।
সরজমিনে ঘরে কাপ্তাইয়ের কয়েকটি ইউনিয়নের ক্ষয়ক্ষতির চিত্র তুলে ধরা হলো—
চন্দ্রঘোনা ইউনিয়ন: কাপ্তাই উপজেলার ১ নম্বর চন্দ্রঘোনা ইউনিয়নে বেশ কিছু এলাকায় রোববার থেকেই পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। তবে প্রাণহানির ঘটনা না ঘটলেও বিভিন্ন বসতবাড়ির ব্যাপক ক্ষতি দেখা গেছে। চন্দ্রঘোনা ইউনিয়নের বড়ইছড়ি এলাকা এবং কলেজ গেইট এলাকায় পাহাড় ধসে অনিল তনচংগ্যা ও রফিকুল ইসলাম সুমন নামের দুইজনের বসতবাড়ির বেশ ক্ষতি হয়েছে।
পাহাড় ধসে বসতবাড়ির প্রায় অর্ধেক পিছনের ছড়াতে পড়ে গেছে অনিল তনচংগ্যার। তিনি জানান, রোববার ভারী বর্ষণ হচ্ছিলো, বাসায় আমি এবং আমার মা ও বোনসহ ছিলাম। হঠাৎ কিছু বুঝে উঠার আগেই বাসার পিছনে রান্নাঘর সহ অর্ধেক ভেঙে ছড়াতে পড়ে যায়। এতে আমাদের বই খাতা সহ অনেক কিছুর বেশ ক্ষতি হয়েছে।
অন্যদিকে কলেজ গেইট এলাকার সুমনের বাসায় সোমবার সকালে পাহাড় ধসে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তারা প্রাণে বাঁচলেও জিনিসপত্রের বেশ ক্ষতি হয়েছে বলে জানান। এছাড়া চন্দ্রঘোনা ইউনিয়নের রেশম বাগান এলাকা সহ বেশ কিছু জায়গায় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে।
এদিকে চন্দ্রঘোনা ইউপি চেয়ারম্যান আক্তার হোসেন মিলন সোমবার সকালে পাহাড় ধসে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা পরিদর্শন করেন এবং আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাসরত ব্যক্তিদের খোঁজখবর নেন।
কাপ্তাই ইউনিয়ন: কাপ্তাই ইউনিয়নের পাহাড় ধসের সব চেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে ঢাকাইয়া কলোনী, আফসারের টিলা, বাংলা কলোনীসহ বেশ কিছু এলাকা। সেখানে সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বেশ কিছু পরিবার আশ্রয়কেন্দ্রে গেলেও অনেক পরিবার এখনো ঝুঁকি নিয়ে বাসাবাড়িতে রয়ে গেছে।
তাদের সাথে কথা হলে অনেকেই জানান, বৃষ্টি আরো বাড়লেপরিস্থিতি খারাপ হলে তখনই যাবো। অন্যদিকে কাপ্তাই উচ্চ বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় বেশ কিছু পরিবার আশ্রয়কেন্দ্রে পরিবার-পরিজন নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন।
সেখানে কয়েকজনের সাথে কথা হলে তারা জানান, প্রায় ৪ দিন আগে পাহাড় ধসের আশঙ্কায় তারা আশ্রয়কেন্দ্রে চলে এসেছেন। আশ্রয়কেন্দ্র নিরাপদে থাকলেও অনেকে বাসাবাড়ির কি হবে সেই চিন্তা করছেন। অন্যদিকে কয়েকটি পরিবার সোমবার সকালেই আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছে। তাদের অনেকের ঘর ইতিমধ্যে পাহাড় ধসে ভেঙে পড়েছে। তবে ঘরবাড়ির ক্ষয়ক্ষতি হলেও প্রাণে বেঁচে গেছেন সকলেই।
কাপ্তাই উচ্চ বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রের দায়িত্বরত প্রধান শিক্ষক মাহাবুব হাসান বাবু জানান, ইতিমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের আশ্রয়কেন্দ্রে আসার প্রবণতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া উপজেলা প্রশাসনের প্রচারণায় অনেকেই সচেতন হচ্ছে। সোমবার বেলা ১টা পর্যন্ত আশ্রয়কেন্দ্রে ৮৫টি পরিবারের ৩৪৪ জন আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের জন্য খাবার ও থাকার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। এছাড়া আরো ১শ জনকে জায়গা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে আশ্রয়কেন্দ্রে।
ওয়াগ্গা ইউনিয়ন: কাপ্তাইয়ের ওয়াগ্গা ইউনিয়নের বেশ কিছু এলাকায় টানা বর্ষণে পাহাড় ধস হয়েছে। ওয়াগ্গাছড়া এলাকায় ছড়াতে পাহাড়ি ঢলে পানির চাপ বেড়ে গেছে এবং আশেপাশের কয়েকটি সড়ক ও এলাকা প্লাবিত হয়েছে বলে জানা গেছে। এতে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়েছে কয়েকটি এলাকায়। তবে এখনো হতাহতের কোন খবর পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে ওয়াগ্গা ইউনিয়নে বেশকিছু কৃষি জমি বৃষ্টি ও ছড়ার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে অনেকেই।
রাইখালী ইউনিয়ন: টানা বর্ষণে কাপ্তাইয়ের রাইখালী ইউনিয়নের বেশ কিছু এলাকায় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কর্ণফুলী নদীর পানি বিপদসীমার কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছে। নদীতেও তীব্র স্রোত দেখা দিয়েছে। এতে রাইখালী ইউনিয়ন সংলগ্ন চন্দ্রঘোনা ফেরীপারাপার বন্ধ করে রাখা হয়েছে। যার ফলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে জীবন জীবিকার তাগিদে অনেক মানুষকে ছোট ছোট বোটে নদী পারাপার করতে হচ্ছে। এছাড়া টানা বর্ষণে কয়েকদিন আগে থেকেই ফেরীর পাঠাতন ডুবে গেছে রাইখালীতে। অন্যদিকে রাইখালীর বেশ কিছু নিম্নাঞ্চল ও সড়কে পানি উঠে গেছে। এতে জনজীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
চিৎমরম ইউনিয়ন: কাপ্তাইয়ের চিৎমরম ইউনিয়নের বেশ কিছু এলাকা অতিদুর্গম এবং পাহাড়বেষ্টিত হওয়ায় টানা বর্ষণে সেখানে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে স্থানীয়দের তথ্য অনুযায়ী টানা বর্ষণে সেখানেও পাহাড় ধসের অনেক ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। দুর্গম অঞ্চলের অনেক মানুষ এক্ষেত্রে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে এবং তারাও অনেকটা পাহাড় ধসের আতঙ্ক নিয়ে দিন পার করছেন।
এদিকে সোমবার সকালে কাপ্তাই উপজেলার বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্র ও এলাকা পরিদর্শন করেছেন কাপ্তাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মহিউদ্দিন। তিনি বলেন, টানা বর্ষণে কাপ্তাই উপজেলায় বিভিন্ন এলাকায় বেশ কিছু ক্ষতি হয়ছে। এর মধ্যে কাপ্তাইয়ের ৪৮টি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে, প্রায় ১৭১টি বসতবাড়ি এবং ৫০ একর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এছাড়া প্রায় ২৪টি বসতবাড়ি পানির স্রোতে প্লাবিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। অন্যদিকে উপজেলার ২টি ব্রীজ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তাছাড়া উপজেলার বেশকিছু এলাকায় সড়কে পাহাড় ধসে যোগাযোগ বিছিন্ন ছিলো সেখানে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহন করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা হয়েছে। বর্তমানে কাপ্তাইয়ে ১৭টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং যেখানে ৩শ ৫৭ জন অবস্থান করছেন বলে তিনি জানান। পাশাপাশি উপজেলা প্রশাসনের রেসপন্স টিম যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত রয়েছে।
মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।