ডায়েরিয়ার প্রকোপ কমছেই না, ব্যক্তি কেন্দ্রিক সচেতনতা বাড়ানো জরুরি

0

চট্টগ্রামে বেশ কয়েকদিন ধরে ডায়েরিয়ার প্রকোপ বেড়েই চলেছে। প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। যা জনমনে আতঙ্কের সৃষ্টি করছে। সর্বশেষ গত ২৪ ঘন্টায় চট্টগ্রামে নতুন করে ২৬১ জন ডায়েরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এই সময়ে সুস্থ হয়েছেন অন্তত ২১৬ জন ব্যক্তি।

বৃহস্পতিবার (১১ মে) বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জেলা সিভিল সার্জন মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী। তিনি বলেন, গত এক সপ্তাহ ধরে চট্টগ্রামে ডায়েরিয়ার রোগী বেড়েছে। গত ২৪ ঘন্টায় নতুন করে ২৬১ জন ডায়েরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে পটিয়া, বোয়ালখালী, চন্দনাইশ এলাকায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি ছিলো।

তিনি আরও বলেন, খাওয়ার পানি কিংবা নানা ধরনের খোলা পানীয় থেকে ডায়রিয়া হয়। ওয়াসার পানিও নানাভাবে দূষিত হয়। পানিতে লবণাক্ততার কারণে অসমোটিক ডায়রিয়া হতে পারে।

এদিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার শামীম আহসান গণমাধ্যমকে বলেন, গত বছরের তুলনায় এই বছর ডায়রিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। আক্রান্তদের অনেকের মধ্যে ‘ভিব্রিও কলেরি’ অর্থাৎ কলেরার জীবাণু পাওয়া যাচ্ছে। তবে শুধু যে এই কারণে ডায়রিয়ার রোগী বাড়েছে তা কিন্তদু নয়। তীব্র তাপপ্রবাহে বিশুদ্ধ পানি বা খাবার গ্রহণ না করা হলেও ডায়রিয়ার সমস্যা হতে পারে।

চট্টগ্রামে ডায়রিয়ার এরকম প্রাদুর্ভাবের কারণ জানতে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) একটি দল এখন চট্টগ্রামে অবস্থান করছে। উপজেলাগুলো পরিদর্শন ও বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষার পরে এই বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দেবে গবেষক দল। তদন্ত প্রতিবেদন পাবার পরেই ডায়রিয়ার মূল কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে বলে মন্তব্য করেছেন আইইডিসিআর এর পরিচালক তাহমিনা শিরিন।

চট্টগ্রামে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস (বিআইটিআইডি) হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ড. মামুনুর রশিদ গণমাধ্যমকে বলেন, হাসপাতালে সম্প্রতি ডায়রিয়ার রোগীর পাশাপাশি কলেরার রোগীও বাড়ছে। যাদের ডায়রিয়া হয় তাদের অনেকের লক্ষণ দেখে আমরা ভিব্রিও কলেরির পরীক্ষা করে থাকি। এখন যারা ডায়রিয়ার রোগী আসছেন তাদের ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ রোগীর দেহে কলেরার জীবাণু পাচ্ছি।

ব্যক্তি কেন্দ্রিক সচেতনতা বাড়ানো জরুরি

চট্টগ্রামে ডায়েরিয়ার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার পর থেকে সম্ভাব্য বেশ কিছু কারণ সামনে এসেছে। তারমধ্যে ওয়াসার পনি, তীব্র গরম, রাস্তার পাশের শরবত বা খাবারের মতো বিষয়গুলোর দিকে সবাই আঙ্গুল তুলছেন। আর এসব বিষয় ‘কারণ’ হিসেবে দাঁড় করানোর পেছনে যথেষ্ট যৌক্তিকতাও রয়েছে। তাই ডায়রিয়া থেকে বাঁচতে আমাদের সকলকে এসব বিষয় থেকে দূরে থাকা উচিত। সামষ্টিকভাবে বৃহৎ পরিসরে এসব সমস্যা নিরসন দরকার হলেও ব্যক্তি কেন্দ্রিক সচেতনতা নিজেদের নিরাপদ রাখতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

জানা গেছে, বিগত বেশ কিছুদিন ধরে নগরীর ওয়াসার পানিতে বেড়ে গেছে লবণাক্ততা। তাছাড়া ওয়াসার পানিতে বিভিন্ন রকমের জিবাণু থাকার আশঙ্কা করা হচ্ছে, যা ডায়রিয়ার একটি বড় কারণ হতে পারে বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা।

এদিকে সরজমিনে দেখা গেছে, নগরীর সড়কের পশে, মোড়ে মোড়ে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে হরেক রকমের শরবত। খোলা পরিবেশে অনিরাপদ বরফ-পানি দিয়ে তৈরি এসব পানীয় খাবলে খাচ্ছেন মানুষজন। তাছাড়া দোকানে দোকানে দোকানে বিক্রি হওয়া বিভিন্ন রকম ভাজাপোড়া খাবারেও মানুষের টান আগের মতোই আছে। তবে গরমের মধ্যে এসব ভাজাপোড়া শরীরে ক্ষতি করতে পারে বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা।

বিআইটিআইডি হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ড. মামুনুর রশিদ বলেন, হাসপাতালে আসা রোগীদের মধ্যে বেশিরভাগই হচ্ছেন কর্মজীবী অর্থাৎ যারা কাজের জন্য বাইরে বের হচ্ছেন তারা ডায়রিয়া বা কলেরায় আক্রান্ত হচ্ছেন। প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে এসব কর্মজীবী মানুষ বাইরে যে পানি বা খাবার গ্রহণ করছেন সেগুলো হয়তো বিশুদ্ধ নয়। এছাড়া, রাস্তার খাবার, লেবুর শরবত-এসব ডায়রিয়ার জীবাণুগুলোর অন্যতম উৎস।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের উচিত নিজেদের সচেতনতা বৃদ্ধি করা। পানি পানের ক্ষেত্রে ‘বিশুদ্ধের’ বিষয়টি সর্বোচ্চ নজরে রাখা। তাছাড়া অপরিচ্ছন্ন, খোলা এবং ভাজাপোড়া খাবার যতটুকু সম্ভব এড়িয়ে চলা। এছাড়া রাস্তার ধারের খাবার সম্পূর্ণরূপে না খাওয়া।

ডায়রিয়া হলে যে পানিস্বল্পতা ও লবণের ঘাটতি দেখা দেয়, তা পূরণ করাই মূল চিকিৎসা। খাওয়ার স্যালাইনে পানিস্বল্পতা দূর করা যায়। মারাত্মক পানিস্বল্পতার লক্ষণ দেখা গেলে রোগীকে শিরায় উপযুক্ত স্যালাইন দিয়ে চিকিৎসা করতে হয়। এ জন্য রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করাই ভালো। তবে আক্রান্ত হওয়ার আগে কিছু বিষয় মেনে চলছে ডায়রিয়ার ঝুঁকি কম থাকে। চলুন জেনে নেই ডায়রিয়া প্রতিরোধের কিছু উপায় সম্পর্কে:

১.বাইরের পানি কোনোভাবেই খাওয়া যাবে না। পানি অবশ্যই ফুটিয়ে খেতে হবে।

২.রাস্তার পাশে যেসব লেবুর শরবত, আখের রস বা ফল কেটে বিক্রি করে তা এড়িয়ে চলতে হবে।

৩.বাইরের খাবার যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলুন। খুব দরকার হলেও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাবার খাওয়া এড়িয়ে চলুন।

৪.অত্যধিক গরমে পানির পিপাসা লাগবে এটাই স্বাভাবিক। এ জন্য নিজের সঙ্গে সব সময় পানির বোতল রাখুন।

৫.পচা-বাসি খাবার খাওয়া বাদ দিন। ফ্রিজে রাখা খাবার খাওয়া এড়িয়ে চলুন।

৬.প্রতিবার বাথরুম ব্যবহারের পর সাবান বা হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে ভালো করে হাত পরিষ্কার করুন।

আপনার মন্তব্য লিখুন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশিত হবে না।