ডেঙ্গু জ্বর—যা জানা একান্তই জরুরী

এডিস মশার স্বভাব যেমন বদলিয়েছে, ডেঙ্গুর লক্ষণ ও প্রকাশ পাচ্ছে বিচিত্রভাবে। ডেঙ্গুতে সারাদেশেই মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। একদিনে যেমন সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড হচ্ছে তেমনি হাসপাতালগুলো ভর্তি হচ্ছেন আক্রান্তরা। এমতাবস্থায় লক্ষণ দেখা দেওয়া মাত্রই আস্থাভাজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে এবং শিশু ও বয়স্কদের প্রতি মনোযোগী হতে পরামর্শ দিয়ে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. আশিকুর রহমান ডেঙ্গু নিয়ে লিখেছেন

ডেঙ্গু জ্বর—কখন হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে?
ডেঙ্গু ভাইরাস টেস্টে পজিটিভ হলেই হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন নেই। বেশিরভাগ ডেঙ্গু রোগীই চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে বাসাতেই অবস্থান করতে পারেন। তবে জ্বর কমে যাওয়ার পরপরই ডেঞ্জার সাইনগুলো সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

ডেঞ্জার সাইনগুলো হলো:
১. অনবরত পেটব্যথা বা পেট শক্ত হয়ে থাকা, ২. ক্রমাগত বমি (দিনে তিন বারের বেশি), ৩. মাড়ি বা দাঁত দিয়ে রক্তক্ষরণ, ৪. রক্তবমি হওয়া, ৫. পায়খানার সাথে রক্ত যাওয়া বা আলকাতরার মত পায়খানা হওয়া, ৬. বুকে ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট হওয়া, ৭. তীব্র মাথা ঘুরানো বা অতিরিক্ত দুর্বলতা, ৮. খিচুনি, ৯. মতিভ্রম বা মানসিক অসগংতি, ১০. দ্রুত প্রেসার কমে যাওয়া, ১১. অসাড় হয়ে পড়া, ১২. হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসা, ১৩. স্বাভাবিকের চেয়ে প্রস্রাবের পরিমান কমে আসা, ১৪. লিভার বড় হয়ে যাওয়া (আল্ট্রা করা থাকলে), ১৫. মহিলাদের ক্ষেত্রে হঠাৎ অতিরিক্ত মাসিকের রক্তক্ষরণ হয়ে দুর্বল হয়ে পড়া বা অসময়ে তীব্র ব্লিডিং হওয়া, ১৬. অজ্ঞান হয়ে পড়লে, ১৭. বাসায় একাকী থাকলে বা পরিচর্যা করার মত কেউ না থাকলে, ১৮. প্লাটিলেট কাউন্ট এক লক্ষের নিচে চলে আসলে উপরোক্ত বিপদচিহ্ন সহ, ১৯. ডেঙ্গুর সাথে প্রেগন্যান্সি থাকলে। সাধারনত গর্ভফুলের নিচে রক্তক্ষরণ হয় ক্রিটিক্যাল পিরিয়ডে, ২০. ডায়াবেটিস, এজমা ও ফুসফুসের রোগ, কিডনি রোগ ইত্যাদির সাথে ডেঙ্গু জ্বর থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।

এইবছর বেশিরভাগ ডেঙ্গুই লক্ষণ ছাড়া দেখা দিচ্ছে। শিশু ও বয়স্কদের ক্ষেত্রে ডেঙ্গু জ্বরের কমন লক্ষণগুলো নাও থাকতে পারে। শুরুতে হালকা জ্বর, শরীর ব্যথা, মাথাব্যথা, মাংসপেশীতে ব্যথা বা ম্যাজমেজ করা, দুর্বলতা ইত্যাদি থাকলেও জ্বর চলে যাওয়ার ৩-৭ দিন বা জ্বর ছাড়া দিনগুলিই সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। যখনই জ্বর চলে যাবে তখন খেয়াল করুন উপরোক্ত বিপদচিহ্নগুলো।

জ্বর কমাতে শুধু প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ সেবন করুন। কোন ধরনের ব্যথানাশক ট্যাবলেট বা সাপোজিটরী ব্যবহার করবেন না। হিতে বিপরীত হতে পারে। ঘরে বানানো ফলের জুস, লেবুর শরবত, ডাবের পানি, ওরস্যালাইন গ্রহণ করুন পানিশুন্যতা রোধ করতে। ডেঙ্গু হলে মশারীর ভেতর অবস্থান করুন। পাশাপাশি ডেঙ্গু মশার বিস্তার রোধে সচেষ্ট হউন।

তিনি আরও লিখেন—
ডেঙ্গু জ্বর শুরুতেই ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইটের বেশি হতে পারে, সাথে মারাত্মক মাথাব্যথা, কোমর ও পিঠ ব্যথা নিয়ে। অবহেলা নয়, আজই চিকিৎসা নিন।
শরীরে জ্বর আসার প্রথম দিন হতেই টেস্ট করে ডেঙ্গু রোগ নির্ণয় করা যায়। জীবন বাজি রাখবেন না। এই সিজনে মারা গিয়েছে ৮৩ জন। হাসপাতালে একদিনেই ভর্তি (১১ জুলাই) সহস্রাধিক।
তীব্র জ্বর সাধারনত ৫-৭ দিন থাকতে পারে। প্রথমদিন থেকেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। এইবার যারা ডেঙ্গুতে মৃত্যুবরণ করেছেন, বেশিরভাগ হাসপাতালে এটেন্ড করেছেন দেরীতে।
জ্বরের ৩য়—৫ম দিন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বিপদচিহ্ন দেখা দেয় সেই সময়ে। রোগীর ক্রিটিক্যাল অবস্থা শুরু হয় উক্ত দিনগুলোতে।

জ্বর চলে যাওয়ার (যখন রোগী ভাবতে শুরু করে ভাল হয়ে গেছেন) পরবর্তী ২৪-৪৮ ঘন্টাই সবচেয়ে বেশি ভয়ানক। বাহিরের কোন লক্ষণ দেখা না গেলেও শরীরে ‘ঝড়’ বইয়ে যায় মুলত সেই জ্বরমুক্ত সময়ে।
হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসা, অতিরিক্ত ঘাম, দুর্বল ও দ্রুত হার্টবিট, প্রেসার অতিরিক্ত কমে যাওয়া, মাথা ঝিমঝিম করা, শ্বাসকষ্ট অনুভব করা, প্রস্রাব কমে আসা, পেট ফোলা ফোলা লাগা ইত্যাদি মারাত্মক বিপদচিহ্ন যা সাধারনত জ্বর ছেড়ে দেওয়ার পর দেখা দেয়।
জ্বর ছেড়ে দেওয়ার ৪—৬ ঘন্টার মধ্যে প্রস্রাব না হলে দ্রুত হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিন। নিজে নিজে বাসায় স্যালাইন পুশ করবেন না। হিতে বিপরীত হতে পারে। ফ্লুইড ওভারলোড হবে অযাচিতভাবে স্যালাইন দিলে। অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুও হতে পারে।
সারাদিনে ৩ গ্রামের বেশি (সর্বোচ্চ ৬টা ট্যাবলেট) প্যারাসিটামল সেবন করা উচিত নয়। জ্বর কমাতে স্পঞ্জিং করুন ( Tepid sponging)। ডেঙ্গুর কারনে লিভারের এনজাইম বাড়ে, তাই অতিরিক্ত প্যারাসিটামল ভয়ংকর হতে পারে। লিভার ফেইলুর হয়ে জটিলতা বাড়বে।

প্লাটিলেট এক লক্ষের নিচে মানে শরীরের কোথাও প্লাজমা লিকেজ ( Plasma Leakage) হচ্ছে। বিপদচিহ্ন নিয়ে সচেতন হউন, প্লাটিলেট কাউন্ট নিয়ে নয়। প্লাটিলেট কাউন্ট ১০ হাজারের নিচেও অনেকের বিপদচিহ্ন দেখা দেয়নি। তাই সচেতন হউন।
ডেঙ্গু জ্বরের ন্যাচারাল প্রসেস অনুযায়ী শুরুতে প্লাটিলেট কমতে থাকে, ৫ম দিন থেকে সাধারনত এই প্লাটিলেট বাড়তে শুরু করে। একবার বাড়তে শুরু করলে সাধারনত আর কমে না যা ইংগিত দেয় রোগীর সুস্থতার।

বাচ্চাদের ক্ষেত্রে সিস্টোলিক প্রেসার অনবরত <৮০ মিমি পারদ চাপ এবং বয়স্কদের ক্ষেত্রে <৯০ হলে রোগী শকে ( Shock) এ আছেন বলে ধরে নেওয়া যায়। বাসায় নিয়মিত তদারকি করুন। প্রেগন্যান্সি ও ডেলিভারী বা অপারেশনের অপেক্ষামান রোগীরা অতিরিক্ত সাবধানতা হিসেবে ডেঙ্গু টেস্ট করিয়ে নেওয়াই শ্রেয়। ডেঙ্গুর জটিলতায় কিডনি, লিভার, ব্রেইন, হার্ট ইত্যাদি অরগান কার্যক্ষমতা হারিয়ে রোগীর আই সি ইউ (ICU) সাপোর্ট লাগতে পারে।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।