তারুণ্যের অনুপ্রেরণার আরেক নাম ‘শেখ কামাল’

‘কামাল তখন অল্প কথা বলতে শিখেছে। কিন্তু আব্বাকে ও কখনো দেখেনি, চেনেও না। আমি যখন বারবার আব্বার কাছে ছুটে যাচ্ছি, আব্বা আব্বা বলে ডাকছি, ও অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে। গোপালগঞ্জ থানায় একটা বড় পুকুর আছে, যার পাশে বড় খোলা মাঠ। ওই মাঠে আমরা দুই ভাইবোন খেলা করতাম ও ফড়িং ধরার জন্য ছুটে বেড়াতাম। আর মাঝে মাঝেই আব্বার কাছে ছুটে আসতাম।

অনেক ফুল, পাতা কুড়িয়ে এনে থানার বারান্দায় কামালকে নিয়ে খেলতে বসেছি। ও হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করল—হাসু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি?’

(‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ বই থেকে নেয়া)

খেলাধুলা, উপস্থিত বক্তৃতা, সংগীত ও অভিনয়সহ বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জৈষ্ঠ্যপুত্র—শেখ কামাল। মাত্র ২৬ বছরের জীবনে বাঙালির সংস্কৃতি ও ক্রীড়াঙ্গনে এক বিরল প্রতিভাবান সংগঠক ও উদ্যোক্তা হিসেবে অসামান্য উচ্চতায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। তিনি ১৯৪৯ সালের এই দিনে তিনি টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন।

শৈশব থেকে খেলাধুলায় ছিলো তার প্রচন্ড ঝোঁক। ক্রিকেটের প্রতি আবেগ এবং দীর্ঘকায় শারীরিক গঠন নিয়ে নিজেকে একজন কার্যকরী ফাস্ট বোলার হিসেবে তৈরি করেছিলেন—শেখ কামাল। বাঙালি এবং মুজিবপুত্র হবার কারণে অবিভক্ত পাকিস্তানের জাতীয় পর্যায়ের ক্রিকেটে নিদারুণভাবে উপেক্ষিত থেকেছেন। শাহীন স্কুল থেকে এসএসসি ও ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে শেখ কামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। সলিমুল্লাহ হলের ছাত্র হিসেবে হলের বাস্কেটবল টিমের ক্যাপ্টেন ছিলেন—শেখ কামাল। বাস্কেটবলে তার অসামান্য দক্ষতার কারণে ঐ সময়ে বাস্কেটবলে সলিমুল্লাহ হল শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখেছিল।

—খেলাধুলার প্রতি অমোঘ আকর্ষণ ও খেলাধুলার প্রসারের লক্ষ্যে দেশের অন্যতম শক্তিশালী ও জনপ্রিয় ক্লাব ‘আবাহনী ক্রীড়াচক্র’ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। পরবর্তী আবাহনী ক্রীড়াচক্র বাংলাদেশের ক্রীড়াক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী বিপ্লবের জন্ম দেয়।

সংগীত শিল্পেও যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন শেখ কামাল। সেতার বাজাতে খুব পছন্দ করতেন তিনি। ছিলেন ছায়ানটের সেতার বাদন বিভাগের শিক্ষার্থী। ওস্তাদ ফুল মোহাম্মদের কাছে নিজ বাড়িতে শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিম নিতেন। ৬৯-এ পাকিস্তান সামরিক সরকার ‘রবীন্দ্র সংগীত’ নিষেধ করলে তার প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠে রবীন্দ্র সংগীত। সেসময় তিনি রবীন্দ্র সংগীত শিল্পীদের সংগঠিত করেন এবং বিভিন্ন সভা এবং জমায়েতে রবীন্দ্র সংগীত পরিবেশন করেন। রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি শিল্পী জাহিদুর রহিমকে দিয়েও গাওয়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বিভিন্ন আন্দোলন পরিস্থিতিতে রবীন্দ্র সংগীতের মাধ্যমে অহিংস পন্থায় প্রতিবাদের দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেন শেখ কামাল।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে নাট্যাঙ্গনেও সুখ্যাতি অর্জন করেন তিনি। বাংলা একাডেমির মঞ্চে অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তার অভিনীত নাটক নিয়ে ভারত সফর করেছেন। বিখ্যাত কবর নাটক মঞ্চস্থ করেছেন কলকাতার মঞ্চে। নাট্য সংগঠন ‘ঢাকা থিয়েটার’ এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা —শেখ কামাল। এছাড়া বন্ধু শিল্পীদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠী’।

১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগের জন্মের বছরে শেখ কামালের জন্ম। আওয়ামী লীগের পথচলার যে ধারাবাহিকতা, বঙ্গবন্ধুর জীবন পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায়, তার প্রভাব শেখ কামালের জীবনের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। ছাত্রলীগের কর্মী এবং সংগঠক হিসেবে ৬ দফা, ১১ দফা আন্দোলন এবং ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল তার। অসামান্য সাংগঠনিক দক্ষতার অধিকারী শেখ কামাল সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ওয়ার কোর্সে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হন পরবর্তীতে মুক্তিবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এমএজি ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের একজন নিবেদিত কর্মী ছিলেন শেখ কামাল। ছাত্রলীগের সংগ্রামী, আদর্শবাদী কর্মী হিসেবে ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান ও মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরোচিত ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সদস্যও ছিলেন শেখ কামাল।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের নির্মম বুলেটের আঘাতে প্রথম শহীদ—শেখ কামাল। বঙ্গবন্ধু স্ব পরিবারে নিহত না হলে বাংলাদেশ পেতো বহুমাত্রিক মেধার অধিকারী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, ক্রীড়াবিদ ও দক্ষ সংগঠক এই নেতাকে।

তারুণ্যের অনুপ্রেরণা বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ক্যাপ্টেন—শেখ কামাল’র ৭৩তম জন্ম বার্ষিকীতে জানাই নিগুঢ় শ্রদ্ধা।

লেখক: উপ-প্রচার সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।