তিন পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান জেলায় পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র্য ধ্বংস সহ অবাদে বৃক্ষ নিধন ও পাহাড় কাটার ফলে সারাদেশে গড় তাপমাত্রার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পাহাড়ের তাপদাহ! ফলে অতিষ্ঠ ও দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন পাহাড়ের জনসাধারণ। তীব্র গরমে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে জনজীবন। এ যেন গ্রীষ্মের প্রথম প্রহরে বৈশাখের দহনজ্বালা।
স্থানীয়রা বলছেন, বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টি হলেও ভ্যাপসা গরম কিছুতে কমছে না। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অসহনীয় লোডশেডিং। ফলে বিঘ্ন হচ্ছে স্বাভাবিক কাজকর্ম। দিনে যেমন রোদের তাপ, রাতে তেমন গরম হাওয়া। বাইরে প্রচণ্ড গরম, আর ঘরে লোডশেডিংয়ের কারণে মানুষ একেবারেই হাঁপিয়ে উঠছে।
মানবাধিকার সংগঠকরা বলছেন, পার্বত্যাঞ্চলে জুম চাষের নামে আগুন জ্বালিয়ে উজাড় করা হচ্ছে শত শত একর সংরক্ষিত বনভূমি। আর এসব হচ্ছে প্রকাশ্যেই। বন বিভাগের কর্মকর্তা ও স্থানীয় প্রশাসনের কোন নজরদারিও নেই।
একই সাথে আগুন জ্বালিয়ে ধ্বংস করা হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী, পশুপাখি ও গাছগাছালি। ফলে মারাত্মকভাবে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য। সংরক্ষিত বনভূমি ও জীব বৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে আবহাওয়া অনিয়ন্ত্রিত ও তাপমাত্রা ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে। অনেকে শ্বাসকষ্ট ও চর্মরোগ সহ বিভিন্ন সমস্যা জর্জরিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
এছাড়া বিভিন্ন ইটভাটা, অবৈধ করাতকলের ও তামাক চাষের জ্বালানী হিসেবে মূল্যবান পাহাড়ি গাছ কেটে প্রতি বছর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি পাহাড় ও প্রকৃতি ধ্বংস করছে তিন পার্বত্য চট্টগ্রামের।
সূত্রে জানা গেছে, প্রভাবশালী স্বার্থান্বেষী মহলের রক্তচক্ষুর ভয়ে অনেকে এ বিষয়ে কথা বলতে নারাজ। বনভূমি উজাড় হয়ে যাওয়ার কারণে পার্বত্য এলাকায় এখন তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে পাহাড়ি জনপদেও বসবাসের জন্য অনেকটা অনুপযোগী হয়ে পড়ছে বলে ধারণা করছে পরিবেশবিদরা।
তীব্র গরমে বিপন্ন জনজীবন
লংগদু উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখা যায়, প্রচণ্ড গরমের কারণে বিভিন্ন হাট-বাজার, মোড়গুলোতে ভ্রাম্যমাণ তরমুজ, ডাব ও আখের রসের দোকান বসেছে। এসব দোকানে ভিড়ও বেশ। এছাড়া গ্রামগুলোতে গরমে অতিষ্ঠ ছোট শিশুরা পুকুর ও নদীতে নেমে ডুব-সাঁতারসহ গোসল করছে। অনেককেই দেখা গেলো, গরম থেকে বাঁচতে ছাতা মাথায় চলাচল করতে।
কাজের প্রয়োজনে যাদের বাহিরে বের হতে হয় তাদের দুর্ভোগ চরমে। দিনমজুর খালেক মিয়া বলেন, অসহ্য গরমে চামড়াসহ জ্বালাপোড়া করে, মাথা ঘুরায়। পেটের দায়ে তাও কাজ করতে বের হতে হয়। লংগদুর কৃষক রহিছ আলী বলেন, রোদ দেখলেই মাথা চক্কর দেয়। প্রচন্ড রোদে মনে হয় এই বুঝি অজ্ঞান হয়ে যাবো। তবু কাজ করতে হয় আমাদের।
স্থানীয় কাঁচামাল ব্যবসায়ী সেলিম বলেন, বেচা বিক্রি দিনের বেলায় অনেক কমে গেছে। দিনের বেলায় মানুষ কম বের হচ্ছে বাসা থেকে। তীব্র রোদে দোকানের কাঁচামালও দ্রুত পচন ধরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ডাঙ্গাবাজার এলাকার মোটর সাইকেল চালক জিতেন চাকমা বলেন, পাহাড়ি এলাকা হিসেবে জানতাম একটু কম গরম পড়বে, এখন দেখি প্রচুর গরম। পাহাড় থেকে অবাধে গাছ কাটার ফল বোধহয় এই প্রচন্ড গরম। রাস্তায় গাড়ি নিয়ে বের হতে পারি না এমন অসহ্য গরম পড়ছে। বৃষ্টিও নাই!
মাইনী বাজারে আখের রস ব্যবসায়ী শরিফুল জানান, এই তাপে একটু স্বস্তি পেতে মানুষ আখের রস পান করছেন। প্রতি গ্লাসের মূল্য নিচ্ছেন ২০ টাকা। গত কয়েকদিন থেকে ৬০০-৭০০ গ্লাস রস বিক্রি করছেন। আগে তিনি প্রতিদিন বিক্রি করতেন ১০০-২০০ গ্লাস রস।
এদিকে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে রাঙামাটিতে সর্বোচ্চ তাপমাত্র রেকর্ড হয় ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রেকর্ড সংখ্যক এ তাপমাত্রায় জেলার বিভিন্ন উপজেলা সদরের রাস্তাঘাট এখন অনেকটা ফাঁকা। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া দিনের বেলায় রোদে কেউ বাহির হচ্ছে না। গরমে দেখা দিচ্ছে সর্দি-জ্বর সহ ডায়রিয়ার মতো অসুখ। হাসপাতাল ও চিকিৎসকের কক্ষে দেখা যায় রোগীদের উপস্থিতি।
লংগদু উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ শাহীন হোসাইন চৌধুরী জানান, প্রচণ্ড এই তাপদাহে বেশি বেশি করে পানি পান করতে হবে। রোদের মধ্যে বেশিক্ষণ চলাচল করা যাবে না। শিশুদের খুবই যত্নে রাখতে হবে যাতে গরমের ঘাম তাদের শরীরে বসে না যায়। এবং অসুস্থ্য হয়ে যারা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন তাদের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখা হচ্ছে।
তবে প্রচণ্ড গরম থেকে বাঁচতে বেশি বেশি পানি পান করার পাশাপাশি খুব বেশি প্রয়োজন না হলে রোদে না যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো স্বাধীনতার ৫২ বছর পেরিয়ে গেলেও বিশুদ্ধ পানির সংকট কাটেনি পার্বত্যাঞ্চলের বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর। বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে সুপেয় পানির তীব্র সংকট। যেন দেখার কেউ নেই বলে অভিযোগ তুলছেন ভুক্তভোগী জনসাধারণ।
রাঙামাটি আবহাওয়া কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, রাঙামাটিতে এখন বৃষ্টির তেমন সম্ভাবনা নাই। এপ্রিল মাসের এই গরম আরও সপ্তাহখানেক থাকবে। তবে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে মৃদু বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এদিকে বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, গরমের তীব্রতা না কমলে লোডশেডিং পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে।
মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।