চট্টগ্রামের রাজনীতিতে সাহস, ত্যাগ ও নেতৃত্বের এক পরিচিত নাম আসলাম চৌধুরী। রাজনৈতিক দমন-পীড়নের দীর্ঘ অধ্যায় পেরিয়েও যিনি কখনও রাজপথ ছাড়েননি। ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে এই বিএনপি নেতা টানা ৮ বছর ৩ মাস ৫ দিন কারাবরণ করেছেন। যা চট্টগ্রামের কোনো রাজনীতিকের জন্য সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের বন্দিত্ব।
দল যখন সংকটে, নেতৃত্ব যখন ঝুঁকির মুখে—তখনই সামনে দেখা গেছে আসলাম চৌধুরীকে। তৃণমূল নেতাকর্মীদের ভাষায়, তিনি শুধু নেতা নন, আন্দোলনের মুখ। তিনি থাকলে আমরা সাহস পাই।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সাল থেকে নানা অভিযোগে অন্তত চারবার গ্রেপ্তার হন আসলাম চৌধুরী। ২০১৬ সাল থেকে টানা জেলে ছিলেন। ৭৬টি মামলা হয় তার নামে। যার বেশিরভাগ মামলাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল বলে দাবি করেন তার আইনজীবী ও সমর্থকরা। সর্বশেষ তিনি প্রায় ৮ বছর ৩ মাস ৫ দিন কারাভোগ করেন। ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার গণঅভ্যুথানের পর তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান।

নেতাকর্মীদের দাবি, আসলাম চৌধুরীকে ঘিরে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও হয়রানির যে ইতিহাস, তা বিএনপির রাজনীতিতে এক অনন্য নজির হয়ে দাঁড়িয়েছে। জেল থেকে মুক্তির পর তিনি বলেছিলেন, ‘আমার অপরাধ একটাই—আমি জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছি, স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ছিলাম। গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছি, করব।’
তৃণমূল নেতাকর্মীদের মতে, এই দীর্ঘমেয়াদি কারাভোগ আসলাম চৌধুরীকে দুর্বল করেনি, বরং তাকে আরও দৃঢ় ও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। উত্তর জেলা বিএনপি সদস্য ও সীতাকুণ্ড উপজেলা বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব জহুরুল আলম জহুর বলেন, ‘আসলাম চৌধুরী শুধু রাজনৈতিক নেতা নন, তিনি প্রতিকূলতার প্রতীক, একজন সংগ্রামী যোদ্ধা।’
ফ্যাসিস্ট হাসিনাবিরোধী আন্দোলন সংগ্রামে গ্রেপ্তার হওয়া সকল নেতাকর্মীদের কারাগারে আগলে রেখেছিলেন আসলাম চৌধুরী। সলিমপুর ইউনিয়ন বিএনপির সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহেদুল ইসলাম বলেন, ‘স্বৈরাচার হাসিনাবিরোধী আন্দোলনে আমাদের অনেক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়ে কারাবরণ করেছিলেন। সেই সময় অন্ধকার কারাগারে আলোকবর্তিকা হয়ে হাজির হন আসলাম চৌধুরী। আর্থিক, মানসিক ও আইনী সহায়তা দেন তিনি। এক মহূর্তের জন্যও নেতাকর্মীদের ছেড়ে যাননি। কারাগারে থেকেও আমরা পেয়েছিলাম তার অভিভাবকত্ব সুলভ ভালোবাসা।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, সরকারের দমনমূলক নীতির শিকার হওয়া নেতাদের মধ্যে আসলাম চৌধুরী অন্যতম। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের বড় অংশই কেটেছে মামলা-হামলা আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই করে। তবে এসব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তাঁর জনপ্রিয়তা তৃণমূলে অটুট রয়েছে।
বিএনপির দলীয় হাই কমান্ড সূত্রে জানা গেছে, আগামী নির্বাচনে যাকে মনোনয়ন দিলে সাধারণ ভোটাররা খুশি হবে, এমন প্রার্থীর হাতেই নির্বাচনি টিকিট দেবে বিএনপি। তবে এক্ষেত্রে মৌলিক নীতি অনুসরণ করা হবে। এজন্য প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে নীতি হিসাবে তিনটি যোগ্যতাকে অন্যতম মানদণ্ড হিসাবে সেট করা হয়েছে। এগুলো হলো- গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াই-সংগ্রামে দেশ ও দলের যে প্রার্থী সবচেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছেন, দ্বিতীয়ত, যিনি সততার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এবং এলাকার জনগণের কাছে একজন ভালো মানুষ হিসাবে সুপরিচিত। তৃতীয়ত, ভোটের রাজনীতিতে যিনি তার নির্বাচনি এলাকায় বেশি জনপ্রিয়। এই তিনিটি মানদন্ডে একক ও অভিন্ন নেতা হিসেবে আসলাম চৌধুরীর নাম উঠে আসে।
সীতাকুণ্ডের বিভিন্ন স্থানে সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, তার মুক্তির পর থেকেই এলাকায় শুরু হয়েছে ব্যাপক রাজনৈতিক তৎপরতা। বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা কাজ করছে। বিভিন্ন জায়গায় বিএনপির গ্রুপিং রাজনীতি থাকলেও সীতাকুণ্ডে আসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে সবাই ঐক্যবদ্ধ। ৫ আগস্টের পর বিতর্কিত কোনো কর্মকাণ্ডে নেতাকর্মীদের তিনি প্রশ্রয় দেননি।
উত্তর জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ মুরসালীন বলেন, ‘আসলাম ভাইয়ের মতো আত্মত্যাগী নেতাকে আবারো মাঠে পেয়ে আমরা উজ্জীবিত। দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় থাকা আসলাম চৌধুরী নানা আন্দোলন-সংগ্রামে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছাত্রদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি মোহাম্মদ মামুন উর রশিদ মামুন বলেন, ‘আসলাম ভাই শুধু নেতা নন, তিনি আমাদের সাহস ও অনুপ্রেরণা। চট্টগ্রামে যিনি সাধারণ কর্মী থেকে শুরু করে জনগণের আস্থা অর্জন করতে পেরেছেন।’
সীতাকুণ্ড উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন, পৌরসভা ও ওয়ার্ড পর্যায়ে বিএনপির নেতা-কর্মীরা জানান, আসলাম চৌধুরী শুধু কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নয়, তৃণমূলেও ব্যাপক জনপ্রিয়। তার রাজনৈতিক অবস্থান, সামাজিক যোগাযোগ এবং দলের প্রতি অবিচল আস্থার কারণে সাধারণ ভোটারদের মাঝেও তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। তৃণমূলে জনভিত্তি এবং দলের প্রতি একাগ্রতা তাকে সীতাকুণ্ড আসনে অন্যতম উপযুক্ত প্রার্থী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি ইকবাল বাহার বলেন, ‘গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে ত্যাগ, সততা, দলের প্রতি কমিটমেন্ট ও জনপ্রিয়তার চূড়ায় অবস্থান করার কারণে তিনি সীতাকুণ্ডে একক ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। দীর্ঘ ৮ বছরেরও অধিক সময় কারাগারে থেকেও তিনি সকল নেতা-কর্মীদের আগলে রেখেছিলেন। দলের ঘোষিত সকল কর্মসূচি ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে একে একে সফল করে হয়েছেন বেশ আলোচিত ও গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব। আগামী সংসদ নির্বাচনে তিনি সীতাকুণ্ডের নির্ভরযোগ্য প্রার্থী হিসেবে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে এই আসনটি দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে উপহার দিবেন। সেই লক্ষ্যে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছি।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাস করে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পরীক্ষায় শিক্ষা ক্যাডারে উত্তীর্ণ হন আসলাম চৌধুরী। ২০০১ সালে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এলে জিয়া পরিষদ গঠন করেই বিএনপির রাজনীতিতে আসেন আসলাম চৌধুরী। ২০১৪ সালের ২৬ এপ্রিল তিনি উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক হন। এর আগে, সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে দলটির কেন্দ্রীয় যুগ্ম-মহাসচিব হন। বর্তমানে তিনি বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
সীতাকুণ্ড উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী হিসেবে তাকেই দেখতে চায় সাধারণ জনগণ। তাদের ভাষায়, এই আসনে প্রতীক নয়, মানুষ দেখে ভোট দিই। আর সেই মানুষটি হলেন আসলাম চৌধুরী। ৪নং মুরাদপুর ইউনিয়নের স্থানীয় কৃষক আইয়ুব আলী বলেন, ‘আমরা অনেক নেতা দেখেছি, কিন্তু আসলাম ভাইয়ের মতো ভদ্র, সাহসী আর আপনজন কেউ না। উনি আমাদের এলাকার গর্ব।’
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আসন্ন নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে সীতাকুণ্ড আসনে তাকে কেন্দ্রীয়ভাবে একক প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তুতি চলছে। এতে স্থানীয় পর্যায়ে বিভাজন থাকবে না এবং নির্বাচনী কর্মকাণ্ড আরও সুসংগঠিত হবে বলেও আশা করছেন নেতাকর্মীরা।

সীতাকুণ্ড উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ডা. কমল কদর বলেন, ‘চট্টগ্রামে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে একটি নাম—আসলাম চৌধুরী। শুধু একজন নেতা নন, তৃণমূল মানুষের কাছে তিনি এখন আবেগ, আস্থা এবং নির্ভরতার প্রতীক। দলের দুঃসময়ে যখন অনেকেই মাঠ ছাড়তে বাধ্য হন, তখনও আসলাম চৌধুরী কর্মীদের পাশে থেকে লড়াই চালিয়ে গেছেন। আন্দোলন-সংগ্রামে তার অগ্রণী ভূমিকা এবং নিঃস্বার্থ নেতৃত্ব তাকে সাধারণ মানুষের হৃদয়ে স্থান করে দিয়েছে।’
মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।