সারাদেশে ব্যাপক উৎসাহ আমেজের মাধ্যমে শেষ হয়েছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচার প্রচারণা। দেশের শক্তিশালী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি নির্বাচনে না আসলেও আওয়ামী লীগের একাধিক স্বতন্ত্র প্রার্থী, ক্রিকেটার, অভিনেতাসহ নানান পেশার মানুষ প্রার্থী হয়েছেন র্নিবাচনে। যার ফলে বেশ আনন্দ-উৎসবের মধ্যে দিয়ে হয়েছে প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণা। আর এখন কেবলই অপেক্ষা ভোটের। আগামী ৭ জানুয়ারি উৎসবমুখর পরিবেশে সংঘাতহীন ভোটের আশা সাধারণ জনগণসহ সংশ্লিষ্টদের।
নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত ১৮ ডিসেম্বর নির্বাচনী প্রচার শুরু হয়। আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী, সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণের ৪৮ ঘণ্টা পূর্বে সব প্রচার বন্ধ করতে হয়। সে অনুযায়ী, আজ শুক্রবার (৫ জানুয়ারি) সকাল ৮টায় প্রচার শেষ হয়।
জানা গেছে, এবার সংসদ নির্বাচনে ২৮টি রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র মিলিয়ে মোট ১ হাজার ৯৭০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর মধ্যে রাজনৈতিক দলের ১ হাজার ৫৩৪ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়াই করছেন ৪৩৬ জন। বিএনপিসহ নিবন্ধিত ১৬ রাজনৈতিক দল ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়ে ভোট ঠেকানোর আন্দোলনে রয়েছে। নওগাঁ-২ আসনের একজন প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে একটি আসনের ভোটগ্রহণ স্থগিত করায় আগামী ৭ জানুয়ারি ২৯৯ আসনে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।
সবচেয়ে বেশি প্রার্থী রয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের। হাইকোর্ট থেকে ৩ জন প্রার্থিতা ফিরে পাওয়ায় দলটির প্রার্থীর সংখ্যা ২৬৬ জন। জাতীয় পাটির ২৬৫ জন, তৃণমূল বিএনপির ১৩৫ জন, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির ১২২ জন, বাংলাদেশ কংগ্রেসের ৯৬ জন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ৫৬ জনসহ ২৮টি রাজনৈতিক দলের মোট প্রার্থী সংখ্যা এক হাজার ৫৩৪ জন। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী ৪৩৬ জন। নির্বাচনে ৯০ জন নারী প্রার্থী ও ৭৯ জন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রার্থীও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
নির্বাচনে ইসলামী ফ্রন্ট বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, গণ ফোরাম, গণফ্রন্ট, জাকের পার্টি, জাতীয় পাটি, জাতীয় পার্টি-জেপি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ, তৃণমূল বিএনপি, ন্যাশনাল পিপলস পাটি, বিকল্প ধারা বাংলাদেশ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, বাংলাদেশ কংগ্রেস, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফ, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পাটি, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এম.এল) ও গণতন্ত্রী পার্টি প্রার্থী দিয়েছে।
এদিকে সব ভোটার যাতে নির্বিঘ্নে ও উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারেন সেজন্য সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এখন ইসির ভাবনায় শুধু নির্বাচন। উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট হবে। ভোটের মাঠ এখন নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে।
মোট ভোটার ১১ কোটি ৯৬ লাখ
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইসি কর্তৃক প্রকাশিত চূড়ান্ত ভোটার তালিকা অনুযায়ী, দেশে মোট ভোটার সংখ্যা ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৮৯ হাজার ২৮৯ জন। ৪ জানুয়ারি রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে কমিশন এ তালিকা প্রকাশ করে।
দেশে পুরুষ ভোটারের সংখ্যা ছয় কোটি ৭৬ লাখ নয় হাজার ৭৪১ জন এবং নারী ভোটারের সংখ্যা পাঁচ কোটি ৮৯ লাখ ১৮ হাজার ৬৯৯ জন। এছাড়া সারাদেশে এবার তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার আছেন ৮৪৯ জন।
দেশের প্রায় ১২ কোটি ভোটারের মধ্যে এই নির্বাচনে প্রথমবার ভোট দেবেন প্রায় দেড় কোটি নতুন ভোটার। এর বাইরে আরও এক কোটি তরুণ ভোটার আছেন। সব মিলিয়ে আড়াই কোটি নতুন ভোটার ভোট দিবেন এবার।
যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে ৫ জানুয়ারি মধ্যরাত ১২টা থেকে ৮ জানুয়ারি মধ্যরাত পর্যন্ত মোটরসাইকেল চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
এছাড়া নির্বাচন উপলক্ষে ভোট গ্রহণের জন্য নির্ধারিত দিবসের পূর্ববর্তী মধ্যরাত অর্থাৎ ৬ জানুয়ারি রাত ১২টা থেকে ৭ জানুয়ারি রাত ১২টা পর্যন্ত কতিপয় যানবাহন চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এসব যানবাহনের মধ্যে রয়েছে ট্যাক্সি ক্যাব, পিক আপ, মাইক্রোবাস ও ট্রাক।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের জারি করা এক পরিপত্রে জানানো হয়।
এ সময় কেবল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী, প্রশাসনের সদস্য ও অনুমোদিত পর্যবেক্ষক, জরুরি সেবার যানবাহন, ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও অভিন্ন কাজে ব্যবহৃত জিনিসপত্র এবং সংবাদপত্র বহনকারী সব ধরনের যানবাহন, দূরপাল্লার যানবাহন, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও তাদের এজেন্টদের ক্ষেত্রে এই বিধিনিষেধ শিথিল করা হবে।
সাংবাদিক, পর্যবেক্ষক, নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী, জাতীয় মহাসড়ক, প্রধান আন্তঃজেলা রুট, মহাসড়ক এবং প্রধান মহাসড়কের সংযোগ সড়কের ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ শিথিল করা হবে।
দুর্গম এলাকার ২৯৬৪ কেন্দ্রে ব্যালট যাবে কাল, বাকি কেন্দ্রে ভোটের দিন
দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন দেশ ও বিশ্ববাসীর কাছে বিশ্বাসযোগ্য করতে প্রথমবারের মতো কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন ভোটের দিন সকালে ৩৯ হাজার ৬১ টি কেন্দ্রে ব্যালট পেপার পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এবারের জাতীয় নির্বাচনে মোট কেন্দ্র রয়েছে ৪২ হাজার ২৫টি।
তবে রিটার্নিং অফিসারের চাহিদার প্রেক্ষিতে পার্বত্য জেলা, উপকূলীয় এলাকা, দ্বীপ, চর অঞ্চল, নদী পরিবেষ্টিত দুর্গম এলাকা বিবেচনায় পরিশিষ্ট-ক তালিকায় বর্ণিত ২ হাজার ৯৬৪ ভোটকেন্দ্রে ভোটগ্রহণের পূর্বের দিন নির্বাচনী মালামালসহ ব্যালট পেপার প্রেরণের বিষয়ে নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন।
জানা যায়, ভোটগ্রহণের দিন সংশ্লিষ্ট সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার রিটার্নিং অফিসার বা সহকারী রিটার্নিং অফিসারের নিকট থেকে ব্যালট পেপার সংগ্রহ করে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার সাথে সকাল ৬টার মধ্যে সংশ্লিষ্ট প্রিজাইডিং অফিসারের নিকট হস্তান্তর করবেন। ভোটগ্রহণের দিন সকালে ব্যালট পেপার পরিবহনের বিষয়ে মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা পরিকল্পনা গ্রহণ করবেন।
নৌকার দুর্গে হানা দিতে পারে ঈগল
এবার প্রথমবারের মতো স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ভোটের মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। দলীয় হাইকমান্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাউকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে বাধা দেওয়া হয়নি। অনেকে বিষয়টিকে নির্বাচন অংশগ্রহণের কৌশল বলেও মনে করছেন। তবে এসব স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে প্রায় সব আসনেই ঈগল প্রতীকের প্রার্থী ভয় ধরাচ্ছে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর বুকে। যার কারণে অনেকেই বলছেন, এবার—‘নৌকার দুর্গে হানা দিতে পারে ঈগল’।
মূলত আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে স্বতন্ত্র হিসেবে ভোটের মাঠে আসা বেশির ভাগ প্রভাবশালীই পেয়েছেন পছন্দের ‘ঈগল’ প্রতীক। তাই ধারণা করা হচ্ছে, অধিকাংশ আসনেই নৌকার সঙ্গে লড়াই হবে ঈগলের। নির্বাচনের আগে প্রচার-প্রচারণায়ও দেখা গেছে নৌকা-ঈগলের সরব উপস্থিতি।
দেশের বিভিন্নস্থানে এই দুই প্রতীকের প্রার্থীর মধ্যে হয়েছে সংঘাতও। শঙ্কা তৈরি হয়েছে নির্বাচনের দিনও ‘নৌকা-ঈগলে’ বেসামাল পরিস্থিতি তৈরি হবার। যদিও সব ধরণের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহীনী।
মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।