দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও ব্যাচেলর জীবনের কষ্টের কথা চিন্তা করে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি উদ্যোগ হাতে নিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ৩ শিক্ষার্থী। তারা হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্স ইন্সটিটিউটের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী অনিক দা, শয়ন মিনজি ও নন্দিনী দেবি তৃষা। ১৫০ গ্রাম মাংস থেকে ২ টুকরো মাছ, যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই মাছ মাংস শিক্ষার্থীদের মাঝে সরবরাহ করছেন তারা।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষার্থীরা কেজি দরে মাছ-মাংস কিনে খেতে পারছেন না কিংবা ব্যাচেলর জীবনে নিজ বাড়ির মতো ফ্রিজ না থাকায় মাছ মাংস সংরক্ষণ করে রাখতে পারছেন না তাদের জন্যই এই উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন তারা। এই উদ্যোগের নাম দিয়েছেন ‘সাধ্যের বাজার’। সর্বনিম্ন ১৫০ গ্রাম মাংস ও সর্বনিম্ন ২-৩ পিস মাছ থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীদের যতটুকু মাছ মাংস প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই সরবরাহ করছেন তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছাড়াও ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরের শিক্ষক কর্মচারী থেকে শুরু করে যে কেউই চাইলে সাধ্যের বাজার থেকে মাছ মাংস কিনতে পারেন।
ব্যতিক্রম এমন উদ্যোগের পেছনের গল্প শুনিয়েছেন উদ্যোক্তারা। অনিক দাস আর শয়ন মিনজি দুজনেই থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ ক্যাম্পাসের একটি বাসায়। মাসকয়েক আগে একদিন নিজেদের জন্য বাজার করতে গিয়ে দেখেন মাছ-মাংস থেকে শুরু করে সবকিছুর দাম বেশি। অতিরিক্ত দাম হওয়ার কারণে কেজি দরে কেনার সাহস তারা পাচ্ছিলেন না। অপরদিকে বিক্রেতারাও অল্প পরিমাণে বিক্রি করতে রাজি হচ্ছেন না । দুজন মানুষের জন্য বেশি পরিমাণে মাছ মাংস কিনলেও ব্যাচেলর বাসায় তা সংরক্ষণ করে রাখার ব্যবস্থা নেই। তখন তারা চিন্তা করেন যে শুধু তারাই নয়, একই সমস্যার ভুক্তভোগী হচ্ছেন হাজারো শিক্ষার্থী। অতিরিক্ত দাম এবং সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা না থাকার কারণে ইচ্ছে থাকলেও মাছ মাংস কিনে খেতে পারছেন না শিক্ষার্থীরা। এই চিন্তা থেকেই তাদের মাথায় এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগের ধারণা জন্ম নেয়। এরপর তারা তাদের সহপাঠী নন্দিনী দেবি তৃষার সাথে বিষয়টি শেয়ার করলে তিনিও বন্ধুদের সাথে রাজি হয়ে যান। ৩ জন মিলে পরিকল্পনা করতে থাকেন কীভাবে তাদের এই চিন্তাকে বাস্তবে রূপ দেয়া যায়। অবশেষে দীর্ঘ আড়াই মাসের চিন্তা পরিকল্পনার পর গত ৮ সেপ্টেম্বর বাস্তব রূপ লাভ করে তাদের এই উদ্যোগ।
সাধ্যের বাজারের উদ্যোক্তা অনিক দাস ও শয়ন মিনজি বলেন, আসলে আমাদের দুজনেরই উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন ছিল দীর্ঘদিনের। প্রথমদিকে ভেবেছিলাম ক্যাম্পাসে একটি ফুড কার্ট দেব। কিন্তু একদিন বাজার করতে গিয়ে ভুক্তভোগী হওয়ার পর সাধ্যের বাজারের এই চিন্তাটি মাথায় আসে। অনেকদিনের পরিকল্পনা আর চেষ্টার পর অবশেষে আমরা তা বাস্তব রূপ দিতে পেরেছি।
তারা জানান, ৩ জন মিলে টিউশনের টাকা জমিয়ে একটি ফ্রিজ কিনেছেন। আর শয়নের আগে থেকেই একটি বাইসাইকেল ছিল। অনিক আর শয়ন ক্যাম্পাসের আশপাশের বাজার থেকে মাছ মাংস কিনে তা একদম সরাসরি রান্নার উপযোগী করে তৈরি করে ফ্রিজে সংরক্ষণ করে রাখেন। মূলত ‘সাধ্যের বাজার’ নামক একটি ফেইসবুক পেইজের মাধ্যমে তারা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। ফেইসবুক পেইজ ও অন্যান্য অনলাইন ভিত্তিক সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যাপারসমূহ দেখাশুনা করেন নন্দিনী। পেইজে প্রতিদিনকার স্টকে থাকা মাছ মাংসের আপডেট ও দাম জানিয়ে পোস্ট করা হয়। গ্রাহকরা পেইজের ইনবক্সে তাদের প্রয়োজনমতো মাছ মাংসের অর্ডার করতে পারেন। অর্ডারের ভিত্তিতে কখনো অনিক আবার কখনও শয়ন বাইসাইকেলে চড়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে গ্রাহকদের অর্ডারকৃত মাছ মাংস ডেলিভারি দেন। এজন্য তারা কোনো প্রকার ডেলিভারি চার্জ নেন না। গ্রাহক যদি সকালে ডেলিভারি নিতে চান তাহলে আগেরদিন দিবাগত রাত ১ টা ও রাতে ডেলিভারি নিতে চাইলে একইদিন বিকেল ৫ টার মধ্যে অর্ডার করতে হয়।
ইতোমধ্যেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অনিক, শয়ন আর নন্দিনীর ‘সাধ্যের বাজার’ সাড়া ফেলেছে বেশ। দিন যত যাচ্ছে সাধ্যের বাজারের ফেইসবুক পেইজে শিক্ষার্থীদের মাছ-মাংসের অর্ডারের পরিমাণ ততোই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেবায় খুশি গ্রাহকরাও। সন্তুষজনক রিভিউ দিচ্ছেন পেইজের ইনবক্সে। আর গ্রাহকদের রিভিউ পেয়ে খুশি উদ্যোক্তারাও। সময় সুযোগ সবকিছু অনূকূলে থাকলে এই কার্যক্রমের পরিধি ধীরে ধীরে বড় করার ইচ্ছা উদ্যোক্তাদের। এছাড়া মাছ মাংসের পাশাপাশি রান্নার অন্যান্য উপকরণ যেমন, সবজি, মশলা, ভোজ্য তেল ইত্যাদি ধীরে ধীরে তাদের তালিকায় যুক্ত করতে পারবেন বলে আশাবাদী তরুণ এই উদ্যোক্তারা।
তাদের ভাষায়, দীর্ঘদিনের উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন, শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ ও আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া ইত্যাদি কথা চিন্তা করেই আমরা এই উদ্যোগটা গ্রহণ করেছিলাম। তবে এত দ্রুত এমন সাড়া পাব তা কল্পনাও করিনি। আমাদের সার্ভিসে গ্রাহকরাও খুব খুশি। তাঁরা আমাদের পেইজের ইনবক্সে খুব সুন্দর সুন্দর রিভিউ দিচ্ছেন। তা দেখে আমাদের কাজের অনুপ্রেরণা আরো বেড়ে যায়। ভবিষ্যতে সময় সুযোগ সব অনুকূলে থাকলে আমরা আমাদের এই উদ্যোগকে আরো বৃহৎ পরিসরে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা আছে।
মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।