পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন চাকসুর জিএস আব্দুর রব
মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
“মা তোমার তো আরো ছেলে আছে, আমাকে তুমি ওদের হয়ে মরতে দাও।” মাকে বলা চাকসুর জিএস শহীদ আব্দুর রবের এসব কথা সত্য হবে কে জানত। মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ছাত্রনেতা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ লড়াই করে শহীদ হন।
শহীদ আব্দুর রব জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুসারী হিসেবে স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য ছাত্রদের অনুপ্রাণিত করার কাজ করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও এর আশপাশের এলাকায় ছাত্র-শিক্ষক ও সাধারণ জনগণকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য সংগঠিত করেন। ১৯৭১ সালের ২ মার্চে চট্টগ্রামের লালদীঘিতে সাহিত্য সংস্কৃতিসেবীদের প্রতিরোধ সংঘ আয়োজন করে এক সমাবেশের। সেখানে তিনি ছয় ছাত্র সংগঠনের পক্ষে বক্তব্য দেন। ৮ মার্চ মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতে সামরিক ট্রেনিংয়ের জন্য পৌঁছে দেওয়ার কাজ শুরু করেন তিনি। ১০ মার্চ চাকসু ভিপি মোহাম্মদ ইব্রাহিম ও জিএস আবদুর রব সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সদস্যদের তাদের অস্ত্র জমা না দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে এক বিবৃতি প্রদান করেন। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানিদের পরিচালিত ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর পরিপেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি সৈন্যদের বাঁধা প্রদানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ আর মল্লিক, অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, ড. আনিসুজ্জামান ও রেজিস্ট্রার খলিলুর রহমান, চাকসু ভিপি-জিএসের উপস্থিতিতে সংগ্রাম পরিষদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী, ইপিআর বাঙালি সেনা ও গ্রামবাসী মিলে ক্যাম্পাস ঘেরাও করে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়।
১১ এপ্রিল বাঁশখালির সাবেক সংসদ সদস্য সুলতানুল কবিরের সাথে পটিয়ার ডাকবাংলোয় দেখা হয় শহীদ সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী, শহীদ ফিরোজ, শহীদ আব্দুর রবের সাথে। তাঁরা সেখানে বসে ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ভারতে যেতে বান্দরবানগামী ইপিআরের একটি লরিতে উঠে পড়েন তাঁরা। বান্দরবান পৌঁছে তাঁরা সেখানকার এসডিও আবদুর শাকুরের সাথে দেখা করে ভারতে যাওয়ার রুট নিয়ে খোঁজ খবর নেন। এসডিও তাদের ভুল পথে এসেছেন বলে জানান। তিনি (এসডিও) তাদের বিকল্প সহজ পথ হিসেবে চন্দ্রঘোনা, কাপ্তাই, পাহাড়তলী হয়ে রামগড় দিয়ে ভারতে যাওয়ার পরামর্শ দেন। পরে তাঁরা চৌদ্দ মাইল পথ হেঁটে চন্দ্রঘোনার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। পথিমধ্যে তাঁদের সাথে যোগ দেন রামুর সিদ্দিক ও মিরসরাইয়ের রুস্তম।
বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর তাঁরা একটি জিপ লক্ষ করলেন। তাঁরা জিপটি থামানোর চেষ্টা করলেও জিপটি দ্রুত বেগে চলে যায়। পরে জিপটি কিছু দূর যাওয়ার পর ছড়ার (পাহাড়ি খাল) মধ্যে অচল হয়ে পড়ে। পরে গাড়িটির কাছে গিয়ে দেখা হয় কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ কলেজের অধ্যাপক দিলিপ চৌধুরী, বোয়ালখালী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মোজাফফর আহমদ, ইউনুস, নরুল ইসলাম, ইদ্রিসের সাথে। সবার অভিন্ন লক্ষ্য জেনে এক সঙ্গে যাওয়া শুরু করলেন। সবাই ধরাধরি করে জিপটি খাড়া করে চড়ে বসলেন। রাতেই তাঁরা চন্দ্রঘোনা পৌঁছালেন। কিন্তু কর্ণফুলীতে কোনো ফেরি না থাকায় সারা রাত বসে থেকে পরের দিন সকালে পার হলেন। দোভাসী বাজারে নাস্তা সেরে আবারও যাত্রা শুরু করলেন। তবে যাত্রা শুরু করার আগে স্থানীয় জনগণ তাঁদের বাঁধা দেয়। কারণ কাপ্তাই রোডে ইতিমধ্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এসে পড়েছে। কিন্তু অদম্য এই সব যোদ্ধা রওনা দিলেন। জিপের সামনে সিটে বসলেন দিলীপ, রব, মোজাফফর। পিছনের সিটে সুলতান, সাইফুদ্দিন, ফিরোজ, সিদ্দিক, রুস্তম, নুরুল ইসলাম। জিপে ছিল বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণার কপি, প্রচারপত্র, অয়্যারলেস সেট, কিছু বেতার যন্ত্রপাতি। জিপের সামনে ছিল একটি মেশিনগান, কয়েকটি রাইফেল ও কয়েকটি হ্যান্ড গ্রেনেড।
১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল জিপটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (বর্তমান চুয়েট)-এর সামনে আসলে রব দেখতে পেলেন কলেজে পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে। তিনি সবাইকে সাবধান করার জন্য চেঁচিয়ে উঠলে ড্রাইভার কড়া ব্রেক কষলেন। ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও পাশে স্কুলের ছাদে আগে থেকে থাকা পাকিস্তানি সৈন্যরা বৃষ্টির মতো গুলি বর্ষণ করলেন। ঝাঁক ঝাঁক মেশিনগানের গুলিবৃষ্টি শুরু হয়। কোনো আড়াল নেই কোথাও। প্রথম গুলিতে গাড়ি অচল হয়ে যায়। পরে অরক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধের চেষ্টা করলেন। কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণ অস্ত্র না থাকায় বেশিক্ষণ প্রতিরোধ করতে পারলেন না তাঁরা। এক এক করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন ভবিষ্যৎ ছাত্রনেতা সাইফুদ্দিন খালেদ আর চাকসু সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রব।
এ বীর শহীদ আব্দুর রব ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৮ সালে ফরিদপুর জেলা (বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলা) কোটালী পাড়া বান্ধাবাড়ী গ্রামে। তাঁর পিতার নাম আবেদ আলী মিয়া এবং মায়ের নাম জনাব রহিমা বেগম। ৫ ভাই ও ৪ বোনের মধ্যে শহীদ আব্দুর রব ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর বাবা রেলওয়ের চট্টগ্রাম অঞ্চলে কর্মরত ছিলেন। আড়াই বছর বয়সে তিনি মা-বাবার সাথে চট্টগ্রামে চলে আসেন। তিনি ১৯৬৪-৬৫ শিক্ষাবর্ষে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে তিনি উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করে। একই কলেজে বিএ অধ্যয়নে ভর্তি হন। ১৯৬৮ সালে তিনি চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সহসভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হন।
চট্টগ্রাম কলেজে থাকাকালীন হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। কিন্তু ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে শহীদ আব্দুর রবকে চূড়ান্ত পরীক্ষার আগে কলেজ ছাড়তে হয়। পরে এক বছর পর সিটি কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে এম এ তে ভর্তি হন।
তিনি ১৯৬৯-৭০ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের প্রথম সাধারণ সম্পাদক জিএস নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ এ গণঅভ্যূন্থানে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। শুধু রাজনীতিতে নয়- সাহিত্য-সংস্কৃতি, খেলাধুলা, স্কাউট, অভিনয়, সমবায় সংস্থা, রেডক্রসসহ বিভিন্ন সংগঠনে যুক্ত ছিলেন। তিনি ১৯৬১-৬২ সালে শ্রেষ্ঠ স্কাউট ও ১৯৬৩ সালে শ্রেষ্ঠ সেবক পুরষ্কারে ভূষিত হন।
শহীদ আব্দুর রব নাটকে অভিনয় ও নাটক পরিচালনা করতেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে রয়েছে- মানচিত্র এলবা, শেষ ফল, আমরা ভাবছি, চাঁদের ছেলে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আব্দুর রবের নামে রয়েছে শহীদ আব্দুর রব হল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর সড়কটিও শহীদ আব্দুর রবের নামে নামকরণ করা হয়েছে। শহীদ আব্দুর রবকে সমাহিত করা হয় চট্টগ্রামের সিআরবিতে। সেখানে তাঁর নামে একটি কলোনীও রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে বীর বাঙালি পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে ৯ মাস সম্মুখ যুদ্ধ করে ছিনিয়ে এনেছিলো বিজয়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রায় ২০০ জন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।
মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ষোলো শহীদের মধ্যে রয়েছে বারোজন ছাত্র, একজন শিক্ষক ও তিন জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। এই ষোলো শহীদের একজন হলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের ভিপি আব্দুর রব। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বীর সন্তানদের স্মৃতি ধারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশমুখে নির্মাণ স্মৃতিস্তম্ভ ‘স্মরণ’ এ রয়েছে শহীদ আব্দুর রবের নাম।
চট্টগ্রাম ২ আসন ফটিকছড়ি এলাকার সাবেক সংসদ সদস্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ও চাকসুর সাবেক ভিপি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাজহারুল হক শাহ চৌধুরী চট্টগ্রাম খবরকে বলেন, ‘আমরা গর্বিত আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলো শহীদ আব্দুর রব।
মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।