পারকির দিকে নজর নেই কারও, বাঁধ ভেঙে খাল সৈকতের চর

কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতের পর ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছেল পারকি সমুদ্র সৈকত। চট্টগ্রাম শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে আনোয়ারা উপজেলায় অবস্থিত এ সৈকত ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ।

স্থানীয়রা সৈকতের চেয়ে একে বেশি চেনে ঝাউবাগান হিসেবে; অর্থাৎ এখানে সৈকত তো আছেই, আছে বিশাল ঝাউবাগান। সঙ্গে আছে সমুদ্রের বিস্তৃত জলরাশি। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে চট্টগ্রামের জনপ্রিয় বিনোদন কেন্দ্র পারকি সমুদ্র সৈকত নিয়ে চলছে নানামুখি আলোচনা। যারা আগে এসেছেন, তাদের কাছে এখন অনেকটাই অচেনা হয়ে পড়েছে আকর্ষণীয় এ সৈকতটি। দেশী বিদেশী পর্যটকদের কাছে চরম আকর্ষণের পারকির চর এখন অন্যরকম। ভরা মৌসুমেও মানুষের পদভারে সেই জমজমাট অবস্থা নেই। নেই সেই হাকডাক-জাঁকজমক অবস্থা। নানা সমস্যাও যেন জেঁকে বসে অযাচিত প্রতিবন্ধকতায় চরটি হারিয়ে ফেলছে তার সৌন্দর্য। আর চরের ব্যবসায়ীরাও মুখোমুখি হয়েছেন কঠিন জীবনযুদ্ধে।

সোমবার (৩০ জুন) বিকেলে সরেজমিনে গিয়ে পর্যটক ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় ১ কিলোমিটারের বেশি এলাকা জুড়ে সৈকতের মূল আকর্ষণ সারি সারি ঝাউ গাছের গোড়ার মাটি সরে গিয়ে উপড়ে পড়েছে। বালুচর ও সারি সারি ঝাউ গাছের করুণ পরিণতিতে সৈকতের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পর্যটক ও স্থানীয়রা। বর্তমানে সৈকতের চরের বাঁধ ভেঙে জোয়ারের পানি উঠানামার কারণে খালে পরিনত হয়েছে সৈকতের চর। দেখে মনে হবে এই যেন এক যুদ্ধে ধ্বংসের অংশের ময়দানে। এছাড়াও সৈকতের বর্তমান অবস্থার কারণে স্বাভাবিক সৌন্দর্য হারিয়ে পর্যটকদের আগ্রহে দিনদিন ভাটা পড়ছে। সেই সাথে সৈকতের পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের নজরদারি ও কার্যকরী পদক্ষেপ না থাকায় দর্শনার্থী ও স্থানীয় সচেতন মহলে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সৈকতে আসা পর্যটকরা অভিযোগ করে বলেন, বর্ষা মৌসুমের শুরু থেকে তীব্র ভূমি ক্ষয়ে হুমকির মুখে পড়েছে পারকি সমুদ্র সৈকত। হারিয়ে যাচ্ছে সৈকতের সৌন্দর্য বর্ধনকারী ঝাউবন। টানা বৃষ্টি ও জোয়ারের তীব্র স্রোতে সৈকতের কোল ঘেঁষা ঝাউ গাছের নিচ থেকে বালু সরে যাওয়াতে ভেঙে গেছে বিভিন্ন এলাকা। স্থানীয়রা সমুদ্র সৈকতটি রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।

পারকি সৈকত এলাকার কয়েকজন দোকানদার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জানান, সৈকতে প্রবল জোয়ারে গোড়ার বালু সরে গিয়ে কাত হয়ে পড়ে গেছে শতাধিক গাছ। যেগুলো রাতের আঁধারে চোরের দলরা কেটে নিয়ে গেছে। অনেকেই মাছের ঘেরের পানি বের করতে গিয়ে কেটেছে বাঁধ। এরপর থেকে সৃষ্টি হয়েছে বাঁধ ও সৈকত ভাঙনের। কয়েক বছর ধরেই সৈকতের এমন হাল হচ্ছে হলেও পারকির দিকে কেউ সু-নজর দেয়নি। তাঁদের আশঙ্কা, দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে এই সৈকত টিকিয়ে রাখাই কঠিন হবে।

উপকূলীয় বন বিভাগ জানায়, আনোয়ারা উপকূল রক্ষার জন্য বন বিভাগ ১৯৯৩-৯৪ এবং ২০০২ সালে প্রায় ৮০ হেক্টর জায়গায় ঝাউগাছ লাগায় পারকি সৈকত ও আশপাশের এলাকায়। তবে গোড়া থেকে বালু সরার কারণে গত পাঁচ বছরে পারকির পাঁচ শতাধিক গাছ কেটে ফেলতে হয়েছে। বর্তমানে একই কারণে হুমকিতে আছে অন্য গাছগুলোও। সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের নজরদারি ও কার্যকরী পদক্ষেপ না থাকায় দর্শনার্থী ও স্থানীয় সচেতন মহলে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, কর্ণফুলী টানেল চালুর অনেক আগে থেকেই দীর্ঘ তিন দশকের বেশি সময় ধরে পারকি সৈকতকে পূর্ণাঙ্গ পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তুলতে স্থানীয় ও দর্শনার্থীদের দাবি যেন কেউ আমলেই নিচ্ছে না। টানেল চালুর পর পারকি সৈকতের সম্ভাবনা অনেকগুণ বেড়ে গেলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও নানা বৈষম্যের গ্যাঁড়াকলে আটকা পড়ে দিনদিন এই সৈকতের পরিবেশ হুমকির মুখে পড়েছে। শত শত ঝাউ গাছ রক্ষায় কোনো পদক্ষেপ নেই। বঙ্গোপসাগরের জোয়ারে পানি ও অতি বৃষ্টির কারণে সৈকত রক্ষার বাঁধ ভেঙে সৃষ্ট খাল মেরামতের কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসনের। এতে পুরো সৈকতের বালুচরে পলি জমে কৃষি জমিতে রূপ নিচ্ছে।

সৈকতে আসা পর্যটকরা জানায়, অফুরান সম্ভাবনার এই সৈকত টানেল চালুর পরও পর্যটকদের কাছে টানতে পারেনি। অথচ টানেলের টোল বাড়াতে পারকি সমুদ্র সৈকত বড় ভূমিকা রাখতে পারে। চট্টগ্রাম শহরের লাগোয়া এ বিনোদন কেন্দ্রটি পর্যটকদের কাছে একটি জনপ্রিয় বিনোদন স্পট। কিন্তু এর বিবর্ণ দশার কোনো পরিবর্তন নেই। সৈকতে প্রবেশের রাস্তা, থাকা–খাওয়ার ব্যবস্থা, নিরাপত্তা, বিনোদন অনুষঙ্গ সব কিছুতেই দৈন্যদশার চিত্র পর্যটকদের হতাশ করে। ৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন পর্যটন কমপ্লেক্সটির কাজের মান নিয়ে শুরু থেকেই অভিযোগ। কয়েক দফা মেয়াদোত্তীর্ণের পর ঠিকাদার এখনো কাজ শেষ করতে পারেনি।

স্থানীয় পর্যটক আবদুর নুর (২৮) বলেন, পারকি সমুদ্র সৈকতে মাছের ঘের ব্যবসায়ীদের এতো অত্যাচারেও স্থানীয় প্রশাসন, পর্যটন কর্পোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট কোনো দপ্তর সু-নজর দেয়নি। যার ফলে এ করুণ দর্শা হয়েছে। দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে বিলুপ্ত হয়ে যাবে পারকি সমুদ্র সৈকতটি।

সৈকতের ব্যবসায়ী কাজী জাফর আহমেদ বলেন, গত কয়েক বছর ধরেও সৈকতের কোনো পরিবর্তন হয়নি। ভাঙন রোধে কেউ নেয়নি কোনো পদক্ষেপ। ব্যবসায়ীদের মধ্যেও মন্দভাব বিরাজ করছে। জানি না ভবিষ্যতে সৈকতের কী হাল হবে?’ কমতে শুরু করেছে পর্যটকও। অনেক পর্যটক চরের দৃশ্য দেখে ফিরে যান।’

পারকি ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম বলেন, বর্ষা ও বঙ্গোপসাগরের জোয়ারের প্রভাবের পাশাপাশি সৈকতের আশপাশ থেকে রাতে বালু তুলে পাচার করছে একটি চক্র। এ কারণেও গাছের গোড়া থেকে মাটি এবং সৈকতে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে এ সৈকত ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।

চট্টগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের আনোয়ারার দায়িত্বে থাকা উপ–বিভাগীয় প্রকৌশলী বর্ণ হক বলেন, ইতিমধ্যে ভাঙন কবলিত এলাকা গুলোতে জিও ব্যাগ বসানোর কাজ চলমান রয়েছে। সাপমারা খালের মুখ থেকে পারকি সৈকত পর্যন্ত ২.৭ কিলোমিটার এলাকার ভাঙন রোধে একটি সুপার ডাইক নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করার জন্য সরকার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এটি বাস্তবায়ন হলে পারকি সৈকত সুরক্ষিত হবে।’

আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাহমিনা আক্তার বলেন, ‘পারকি সমুদ্র সৈকত রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।