পাহাড়ের সৌন্দর্য মাচাং ঘর; ইট-পাথরের চাপে বিপন্ন প্রায়!

পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসকারী বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পাহাড়িরা যেন নানাভাবেই শিল্পী। তারা নিজেদের পোশাক নিজেরাই তৈরি করেন। খাবার তৈরিতেও তাদের রয়েছে নিজস্বতা। তবে সব পাহাড়ির একটি জিনিসে মিল খুব বেশি, তা হলো তাদের তৈরি ঘর। যেগুলোকে তারা মাচাং ঘর বলে। আর এ ঘরগুলো তৈরি হয় ছন দিয়ে। ছনের মাচাংগুলো দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি শীতল, আকর্ষণীয় ও আরামদায়ক। যদিও আধুনিকতার ছোঁয়ায় ছনের তৈরি ঘরের প্রবণতা একটু কমে গেছে। তবে পার্বত্যাঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলো পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে ছন দিয়ে মাচাং তৈরি করে এখনো বসবাস করছে।

জানা গেছে, আদিকাল থেকে পাহাড়ি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলো বন্যপশু ও জীবজন্তুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে মাচাং ঘরে বসবাস করত। মাচাংগুলো সাধারণত মাটি থেকে ৫-৬ ফুট উঁচু করে তৈরি হতো। আর মাচাং তৈরির একমাত্র উপকরণ ছিল পাহাড়ি ছন ও বাঁশ। তাই একসময় পার্বত্যাঞ্চলে ছনের ব্যাপক কদর ছিল। কিন্তু কালের বিবর্তন ও জুম চাষের ফলে ছনের উৎপাদন কমে যাবার কারণে হুমকিতে পড়েছে পাহাড়িদের ছনের ঘর।

রাঙামাটির লংগদু উপজেলার দুলুছড়ি এলাকার বাসিন্দা সুজিত চাকমার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, আজকাল জঙ্গলে বাঁশ-গাছ পাওয়া যায় না। বাজারে কিনতে পাওয়া বাঁশের দাম অনেক বেশি, তাই এখন আর মাচাং ঘরের দেখা মেলে না। সম্পূর্ণ বাঁশ, গাছ আর ছন দিয়েই তৈরি হতো মাচাং ঘর। ঘরের মূল খুঁটিগুলো হয় গাছ দিয়ে। আবার অনেক ক্ষেত্রে বড় বড় বাঁশেও খুঁটি তৈরি হয়ে থাকে। মাচাংয়ের সঙ্গে খুঁটির যে সন্ধি বা সংযোগ রয়েছে, সেগুলো বাঁধাই করা হতো বাঁশের বেত দিয়ে। অল্প বয়সী কঁচি বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হয় এই বেত। বাড়ির মাচাংকে ধরে রাখতে মাচাংয়ের সমান্তরাল বাঁশের সঙ্গে খুঁটির প্রত্যেকটি সন্ধিতে মাটি থেকে দেওয়া হতো ঠেঁস। কাঠ, বাঁশ আর ছন দিয়ে তৈরি মাচাং ঘরের তেমন দেখা মেলে না। বাঁশ, বেত আর খুঁটির দাম বেশি হওয়ায় মাচাং ঘরের প্রতি তেমন আগ্রহ নেই চাকমা সম্প্রদায়ের লোকদের। যার কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী এই ঘর।

এ ব্যাপারে লংগদু সরকারী কলেজে অধ্যয়নরত নুনি চাকমা বলেন, সামর্থ্য থাকলেও সচ্ছল ব্যক্তিরা মাচাং ঘর তৈরি করে না। কারণ তিন থেকে চার বছরের বেশি টিকে না। তাছাড়া বন-জঙ্গলে প্রতিনিয়ত উজাড় হচ্ছে প্রচুর গাছ-বাঁশ। তাই খরচ একটু বেশি হলেও স্থায়িত্বের কথা ভেবে অনেকেই ইট-পাথরের ঘর তুলতে আগ্রহী।

উপজেলা সদর থেকে ৮-১০ কি.মি দূরে কারবারি পাড়ায় গেলে দেখা মিলে মাচাং ঘরের। কিন্তু সেখানেও আধুনিকতার ছোঁয়া, কিছু জায়গা জুড়ে গড়ে উঠেছে ইট-পাথরের ঘর, দূর পাহাড়ে জুম মৌসুমে কেবল দেখা মেলে এই মাচাং ঘরের।

এদিকে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক উন্নয়ন সংশ্লিষ্টরা জানান, অবস্থানগত পরির্বতন কারণে পাহাড়িদের মাচাং ঘর বিলুপ্তির পথে। তাছাড়া বন উজাড়ের কারণে আগের মতো তেমন কাঠ-বাঁশও পাওয়া যায় না। ঐতিহ্যবাহী মাচাং ঘরকে টিকে রাখতে হলে সরকারী-বেসরকারী ভাবে সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।

এদিকে পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা জানান, আদিকাল থেকে পাহাড়িরা মাচাং ঘরে বসবাস করে আসছে। আগে আমরা পাহাড়ে যেতে ভয় পেতাম কারণ যেদিকে দেখি সেদিকে বড় বড় বন। কিছু স্থানীয় অসাধু বন খেকোদের কারণে পাহাড়ে বৈচিত্র্যময় বনগুলো উজার হয়ে গেছে। কিছু সেগুন ও গামারি গাছের বাগানের যোট পারমিট দেখিয়ে বনগুলোকে উজার করে দিচ্ছে। এতে হারিয়ে যাচ্ছে বাঁশ-ছন-গাছ।

উল্লেখ্য, পাহাড়িদের তৈরি এসব মাচাং ঘর একদিকে যেমন স্বাস্থ্য সম্মত ও নিরাপদ অন্যদিকে দৃষ্টি নন্দনও। প্রতিটি মাচাং ঘর তৈরিতে খরচ হয় প্রায় লাখ খানেক টাকা।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।