পাহাড় কাটছে কেইপিজেড, আদালতের নির্দেশে বন্ধ করলো প্রশাসন

লুসাই পাহাড় থেকে নেমে ছোট ছোট তুলে বয়ে গেছে কর্ণফুলী নদী। তার তীরেই গড়ে উঠেছে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম। নদীর পার হলেই কর্ণফুলী ও আনোয়ারা উপজেলা। নদী-সমুদ্র পরিবেষ্টিত এ উপজেলার অপার সৌন্দর্য নদীতীরের দেয়াং পাহাড়। সৌন্দর্য ও ঐতিহ্যের এই পাহাড় আজ আর অক্ষত নেই। খননযন্ত্র দিয়ে তা কেটে মাটি অপসারণ করে সমতল করা হচ্ছে। আর এসব পাহাড় কাটার ঠিকাদারিতে রয়েছে আনোয়ারা-কর্ণফুলী উপজেলার রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালীরা।

আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলার বিভিন্ন অংশে কেইপিজেডের শিল্পায়নের নামে পাহাড় কাটার দায়ে হাইকোটের নির্দেশে মঙ্গলবার (১ নভেম্বর) দুপুরে আনোয়ারা উপজেলার প্রশাসন পাহাড় কাটার বন্ধ করে দেয়। হাইকোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গলবার (১ নভেম্বর) দুপুরে কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন কেইপিজেডে পাহাড় কাটার কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন উপজেলা প্রশাসন। উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল্লাহ আল মুমিন এ অভিযানে নেতৃত্ব দেন। তাঁর সঙ্গে কর্ণফুলী ও আনোয়ারা থানা পুলিশের সদস্যরাও ছিলেন।

উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল্লাহ আল মুমিন বলেন, মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করে কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ পাহাড় দীর্ঘদিন ধরে কাটছে পাহাড়। মঙ্গলবার জেলা প্রশাসক মহোদয়ে নির্দেশে অভিযান চালিয়ে পাহাড় কাটার কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, দশ বছর ধরে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার বড়উঠান দৌলতপুর এলাকার কেইপিজেড অঞ্চল, আনোয়ারা উপজেলার বৈরাগ ইউনিয়নের মধ্য বন্দর, উত্তর বন্দর, মোহাম্মদপুর, ফকিরখিল ও হাজিগাঁও এলাকায় চলে পাহাড় কাটা। কয়েক বছর আগে হাজিগাঁও ও মোহাম্মদপুর এলাকায় পাহাড় কাটা বন্ধ হলেও বড়উঠান দৌলতপুর এলাকার কেইপিজেড অঞ্চল এলাকায় এখনো পাহাড় কাটার মহোৎসব চলছে। দিন-রাতে খননযন্ত্র দিয়ে বড় উঠান এলাকা থেকে আনোয়ারা বৈরাগ পর্যন্ত উঁচু পাহাড় কেটে মাটি অপসারণ করে সমতল করা হয়েছে। অপার সৌন্দর্য নদীতীরের দেয়াং পাহাড়ের সৌন্দর্য ও ঐতিহ্যের সেই রূপ এখন বিলুপ্তের পথে। বাকি যে টিলা-পাহাড়গুলো রয়েছে, সেগুলো কেটে মাটি একস্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে ভরাট করে গড়ে উঠছে কারখানা, ইমারত, রাস্তা।

২০১২ সালে পাহাড় কেটে পরিবেশ ধ্বংসসহ পরিবেশ আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে কেইপিজেডের (কোরিয়ান রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকা) তিন শীর্ষ কর্মকর্তার পাশাপাশি অজ্ঞাত আরও সাত থেকে আটজনকে আসামি করে মামলাও করেন পরিবেশ অধিদপ্তর। কর্ণফুলী ও আনোয়ারা উপজেলার আড়াই হাজার একর পাহাড়ি ভূমিতে কেইপিজেড গড়ে উঠছে। পরিবেশ অধিদপ্তর ২০০৯ সালের ২৩ নভেম্বর ৩৩টি শর্তে কেইপিজেডকে পাহাড় কাটার অনুমতি দেয়। শর্তে লেখা আছে, অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী পাহাড় কর্তন ও মোচন করা যাবে। পাহাড়-টিলা কাটার আগে পরিবেশ অধিদপ্তরকে জানাতে হবে।

কিন্তু এসবের কিছুই তোয়াক্কা না করে দীর্ঘ দশ বছর ধরে নির্বিচারে কাটছে পাহাড়। এসব নির্দেশ অমান্য করায় মহামান্য হাইকোর্ট পাহাড় কাটা বন্ধ রাখার জন্য নির্দেশ দেন।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ পাহাড়ের পাদদেশে টার্ফিং, স্ট্যাবিলাইজিং, সিল্ট ট্র্যাপ ইত্যাদি ব্যবস্থা না নিয়েই ভূমি উন্নয়নের নামে এসব পাহাড় কেটে যাচ্ছে সমানে। দেয়াং পাহাড়গুলো যখন ছিল, তখন লোকালয়ে কখনো হাতি আসত না। কেইপিজেড একের পর এক পাহাড়গুলো কেটে শেষ করছে। এখন বন্যপ্রাণীগুলো তাদের বাসস্থান হারিয়ে দিন-দুপুরে চলে আসে লোকালয়ে। দেয়াং পাহাড় এখন নামে আছে, উঁচু পাহাড়গুলো কেটে সমতল করে দিচ্ছে। তারা যেভাবে পাহাড় কাটা অব্যাহত রেখেছে, আগামী কয়েক বছর পর পাহাড়ের নিশানাও থাকবে না বলে স্থানীয়দের শঙ্কা।

পাহাড় হারিয়ে গেলে কিছুদিন পর জীবজন্তু সবই লোকালয়ে চলে আসবে। তাদের বেপরোয়া পাহাড় কাটার মাশুল দিচ্ছে এলাকাবাসী। জলাধার ভরাটের কারণে বর্ষায় পানি নামে লোকালয়ে। এ জন্য পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি স্থানীয়দের ভোগান্তি হয়। আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলার বিভিন্ন অংশে কেইপিজেড শিল্পায়নের নামে কাটছে পাহাড়। এখন দিনে-রাতে পাহাড় কাটায় অসাধু কর্মকর্তারা স্থানীয়দের যেতেও দেয় না কেইপিজেডের ভিতরে। দীর্ঘ দশ বছর পর পাহাড় কাটা বন্ধ করায় স্থানীয়দের মাঝে স্বস্তি দেখা গেছে।

জানতে চাইলে আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ জোবায়ের আহমেদ বলেন, শিল্পায়নের নামে দেয়াং পাহাড়সহ কেইপিজেডের পাহাড়কে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলেছে। পরিবেশ রক্ষায় তারা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। মহামান্য হাইকোর্ট পাহাড় কাটা বন্ধ রাখার জন্য নির্দেশনা দেয়ার পরও বন্ধ রাখেনি পাহাড় কাটা। এবার থেকে এভাবে পাহাড় কাটার সুযোগটা আর থাকবে না। মঙ্গলবার দুপুরে পাহাড় কাটার কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, যদি নির্দেশনা অমান্য করে আবারও পাহাড় কাটার কাজ শুরু করে তাহলে নেওয়া হবে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা।

কেইপিজেডের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) মো. মুশফিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে অনুমতি নিয়েই এখানে শিল্পায়নের জন্য প্লট ও সড়ক তৈরি করছি। পরিবেশের যাতে ক্ষতি না হয়, সেভাবে পাহাড়ের টিলা কেটে সমতল করা হচ্ছে। যেসব শর্তে পরিবেশ অধিদপ্তর অনুমতি দিয়েছে আমরা কোনোভাবেই ওই শর্ত লঙ্ঘন করিনি।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।