আমরা যখন বাইরে মুখরোচক খাবারে তৃপ্তি খুঁজি বা কাজের চাপে খাওয়া-দাওয়ার ঠিক ঠিকানা রাখি না, তখন আমাদের শরীরের ভেতরে এক অদৃশ্য যুদ্ধ শুরু হয়। ফলে গ্যাস্ট্রিক, হজমের সমস্যা এগুলো হরহামেশাই দেখা যায়। তবে এগুলো এখন আর সাধারণ বিষয় নয়, হতে পারে বড় রোগের আগাম বার্তা। দ্রুত নগরায়ণ, অনিয়মিত জীবনযাপন ও অতিমাত্রায় প্রক্রিয়াজাত খাবার গ্রহণের ফলে বাংলাদেশে গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি বা পরিপাকতন্ত্রসংক্রান্ত রোগ ক্রমেই উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে জিইআরডি, আইবিএস, ফ্যাটি লিভার, হেপাটাইটিস (বিশেষ করে বি ও সি টাইপ), আলসার, ক্রোন’স ডিজিজ এবং কোলোরেক্টাল ক্যান্সার। জিইআরডি-তে পেটের অ্যাসিড বারবার উপরের দিকে উঠে এসে বুকজ্বালা বা খারাপ স্বাদের অনুভব তৈরি করে। আইবিএস-এ পেট ফেঁপে যাওয়া, মলত্যাগে সমস্যা বা পেটব্যথা দীর্ঘদিন ধরে চলতে পারে।
নগর জীবনের ব্যস্ততা, অতিরিক্ত স্ট্রেস, ফাস্ট ফুড, মসলাযুক্ত খাবার আর পর্যাপ্ত পানি ও ঘুমের ঘাটতি সব মিলিয়ে আমাদের হজমতন্ত্র ক্রমাগত চাপের মুখে। যারা দিনে ৮-১০ ঘণ্টা বসে কাজ করেন, নিয়মিত শাকসবজি খান না বা অনিয়মিত খাবার খান, তাদের মধ্যে এই সমস্যাগুলোর হার বেশি। আগের মতো হাঁটাহাঁটি, গ্রামীণ খাদ্যাভ্যাস, ঘরে তৈরি খাবার কমে যাওয়াতেই হজম ও লিভারজনিত সমস্যাগুলো বেড়ে চলেছে।
বাংলাদেশে এখন অনেক মানুষ জানেই না যে তারা ফ্যাটি লিভারে ভুগছেন। এটি মূলত লিভারে চর্বি জমার কারণে হয় এবং দীর্ঘমেয়াদে লিভার সিরোসিস বা এমনকি লিভার ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা, অতিরিক্ত শর্করা ও চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণ এবং অ্যালকোহল ব্যবহারের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত এই রোগ। কিন্তু ভয়ের বিষয় হলো, যারা অ্যালকোহল গ্রহণ করেন না, তাদের মধ্যেও ‘নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ (এনএএফএলডি)’ দিন দিন বেড়েই চলেছে।
এন্ডোস্কোপি ও কোলনোস্কোপি এই দুইটি পরীক্ষাই হজম ও অন্ত্রের রোগ নির্ণয়ে অত্যন্ত কার্যকর। অনেক ক্ষেত্রেই কোলোরেক্টাল ক্যান্সার বা আলসার সময়মতো ধরা পড়লে সহজেই নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। এ ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের এভারকেয়ার হাসপাতাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এখানে আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন এন্ডোস্কোপি ও কোলনোস্কোপি সেবা দেওয়া হচ্ছে, যেখানে দক্ষ গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্টদের তত্ত্বাবধানে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা সম্ভব। আর ঢাকামুখী না হয়ে চট্টগ্রামেই আন্তর্জাতিক মানের সেবা পাওয়া যাচ্ছে।
সম্প্রতি গবেষণায় দেখা গেছে, গাট মাইক্রোবায়োম অর্থাৎ আমাদের অন্ত্রে বসবাসকারী উপকারী জীবাণুগুলোর সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে আমাদের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার। ভুল খাদ্যাভ্যাসের কারণে এই মাইক্রোবায়োমের ভারসাম্য নষ্ট হলে শরীর নানা রোগে আক্রান্ত হয়। তাই প্রোবায়োটিক সমৃদ্ধ খাবার, যেমন দই, এবং প্রচুর ফাইবারসমৃদ্ধ ফলমূল খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
পরিপাকতন্ত্রের যত্ন নেওয়া এখন আর শুধু পেট ব্যথা বা গ্যাস্ট্রিক কমানোর বিষয় নয়, এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সচেতনতা। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত স্ক্রিনিং ও সচেতনতা বাড়িয়ে এই সমস্যাগুলোর সঙ্গে লড়াই করা সম্ভব। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পাশাপাশি জনগণের মধ্যে সচেতনতা ছড়িয়ে দিলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আরও সুস্থ রাখা যাবে।
লেখক
এমবিবিএস, এমডি (হেপাটোলজি) ম্যাক্স ফেলোশীপ এডভান্সড জিআই এন্ডোস্কোপি এন্ড গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি ম্যাক্স সিএলবিএস ট্রেইনিং ইন ট্রান্সপ্লান্ট, হেপাটোলজি (ম্যাক্স হসপিটাল, দিল্লী)
এটেন্ডিং কনসালটেন্ট
গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি এন্ড হেপাটোলজি
এভারকেয়ার হসপিটাল চট্টগ্রাম



মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।