ওমান প্রবাসী পিতাকে বিদায় দিয়ে শহর থেকে গ্রামের বাড়ি সন্দ্বীপ ফিরছিলেন আনিকা, আদিফা ও আলিভা। কে জানতো বাবাকে দেশের বাইরে বিদায় দিয়ে এই পৃথিবী থেকে এক সাথে বিদায় নিবে তিন বোন! সমীরের ৬ বছরের সন্তান সৈকতেরও একই দশা। সান্তনা দেয়ার মতো সব ভাষাও যেন হারিয়ে গেছে সন্তানহারা মা-বাবার নিকট।
বড় মেয়ের লাশ ও ছোট জমজ দুই মেয়ের নিখোঁজের ঘটনায় মায়ের সাথে স্বজনদের চিৎকারে ভারী হয়ে উঠেছে দ্বীপ-জনপদ। একসাথে পৃথিবীতে এসে আবার একসাথে সাগরে ভেসে চলে যাওয়ার এই নির্মম দৃশ্য শোকের জন্ম দিয়েছে জনমনে।
বুধবার (২০ এপ্রিল) চট্টগ্রাম-সন্দ্বীপ নৌরুটে স্পিডবোট দুর্ঘটনায় দুই পরিবার হারিয়েছেন চার সন্তানকে। মগধরা ৬ নং ওয়ার্ডের আমতলী এলাকার বড় ছাইয়ার বাড়ির প্রবাসী আলাউদ্দীনের তিন মেয়ের মধ্যে এক মেয়ের লাশ পেলেও এখনো পাননি জমজ দুই শিশুর লাশ।
অন্যদিকে একই এলাকার সেকান্দার কোম্পানীর বাড়ির সমীর তাকিয়ে আছেন সাগরে ডুবে যাওয়া তার পুত্র সন্তান সৈকতের (১০) দিকে।
স্পীডবোট থেকে বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের ভাষ্যমতে, সকাল সাড়ে আটটায় কুমিরা ঘাট থেকে যাত্রা করেন তারা বাইশজন। বোটে উঠার পর সবাইকে লাইফ জ্যাকেট দিলেও বরাবরের মতো কোন জ্যাকেট দেয়া হয়নি শিশুদেরকে।
মাঝপথ পাড়ি দেয়ার পর থেকে হঠাৎ বাতাস শুরু হয়। সন্দ্বীপের কিনারায় পৌঁছার আগেই বাতাস বাড়তে থাকে। বাতাসের বেগের কারনে স্পীডবোটটি নির্দিষ্ট পথ থেকে দক্ষিণ দিকে চলে যেতে থাকে।
কিছুদুর যাওয়ার পর যাত্রীরা কিনারা দেখতে পাওয়ায় সেখানে নামিয়ে দিতে বলেন চালককে। কিন্তু চালক পেছনের দিকে ফিরে যেতে চেষ্টা করলে তখনই উত্তাল ঢেউয়ে স্পীডবোটের পাখার সাথে জেলেদের জাল পেঁছিয়ে গেলে বোটে পানি ডুকতে থাকে। এসময় চালক জাল কাটার জন্যে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বোট থেকে নেমে যাওয়ায় যাত্রীদের মাঝে আতংক সৃষ্টি হয়।
চালকের হাল ছেড়ে কূলে উঠে যাওয়ার চেষ্টা দেখে পানি ভর্তি বোট থেকে নেমে জীবন বাঁচাতে হিমশিম খেয়ে পড়েন যাত্রীরা। এসময় বয়স্ক যাত্রীদের গায়ে লাইফ জ্যাকেট থাকলে শিশুদের কারো গায়ে লাইফ জ্যাকেট না থাকায় জীবন বিপন্ন হয়ে উঠে তাদের। অনেকে বিভিন্নভাবে বেঁচে গেলেও চারজন পাড়ি জমান না ফেরার দেশে।
কোন ধরনের জবাবদিহিতা না থাকায় আগের মতো এবারের বৈশাখের শুরুতেও দুর্ঘটনাকে হত্যাকান্ড বলেছেন সন্দ্বীপের মানুষ। উত্তাল সাগরের বুকে সন্দ্বীপবাসির জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা এখন নিত্যদিনের বিষয় হয়ে উঠেছে সংশ্লিষ্টদের কাছে। কোন কিছুরই তোয়াক্কা না করে দিনের পর দিন এভাবে মানুষের জীবন-মৃত্যু নিয়ে খেলছেন ঘাট ইজারাদারসহ পুরো সিন্ডিকেট।
অদক্ষ নৌযান চালক, ফিটনেস বিহীন নৌযান, অনিরাপদ যাতায়াত ও ভাড়া নৈরাজ্যের মধ্যেই চট্টগ্রাম জেলার একমাত্র দ্বীপ উপজেলার বাসিন্দাদের নিত্য সঙ্গী।
এর আগে ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে অবৈধ লাল বোট ডুবে ১৮ জন প্রাণ হারান। ঘটনার পাঁচ বছর পার হলেও কোন ধরনের নিরাপদ যাতায়াতের ব্যবস্থা করেনি ঘাট ইজারাদার, বিআইডব্লিউটিসি, জেলা পরিষদ। আর জীবন দিয়ে খেসারত দিচ্ছেন সন্দ্বীপের লক্ষ লক্ষ মানুষ।
এদিকে ঘটনার বারো ঘন্টা পার হলেও নিখুঁজ তিনজনকে উদ্ধারে ব্যর্থ হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে আর্থিক অনুদানের মাধ্যমে শান্তনা দেয়ার চেষ্টা করছে প্রশাসন।
সন্তান হারা মা-বাবা ও স্বজনদের আকুতি শেষবারের মতো যেন নিখোঁজ সন্তানদের জীবিত হোক বা মৃত, তাদের কাছে এনে দেওয়া হয়।
মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।