সকল অনিয়মই যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির দাঁতমারা তারাখোঁ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষাদান পদ্ধতির আইন অমান্য, কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বেত্রাঘাত, প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে সরকারি বরাদ্দের স্লিপ ও রুটিন ম্যান্টেইনেন্স ফান্ডের অর্থ ব্যয়ে নয় ছয়, স্কুলের শ্রেণি কার্যক্রমে অনিয়ম, প্রাত্যহিক সমাবেশ না করা, জাতীয় পতাকা উত্তোলন না করাসহ নানা অভিযোগ স্কুলটির প্রধান শিক্ষক মোমিনুল ইসলাম প্রকাশ মোমিন হুজুরের বিরুদ্ধে। এছাড়াও বিভিন্ন কাজের অজুহাতে নিজের ইচ্ছেমতো স্কুলে অনুপস্থিত থাকা, আবার উপস্থিত থাকলেও শ্রেণি কার্যক্রমে গাফেলতিসহ স্কুলের নির্ধারিত পোশাক দেয়ার নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্থ আদায়সহ এমন কোন অনিয়ম নাই যা এই প্রতিষ্ঠানে হয় না বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
জানা যায়, ১৯৯৭ সালে স্কুলটিতে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন মোমিনুল ইসলাম। ২০১৩ সালে সরকারীকরণ হয় এ বিদ্যালয়টি। সেই থেকে স্কুলের পড়ালেখাসহ অবকাঠামোগত উন্নয়নে উপজেলার অন্যান্য স্কুলের মত সরকারি প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ পেয়ে থাকে এ স্কুলটিও। কিন্তু নিজের স্বেচ্ছাচারিতা আর নানা অনিয়মের কারণে পড়ালেখার গুণগত মানোন্নয়ন না হলেও সরকারি ফান্ডের অর্থ আত্মসাৎ করে নিজের উন্নতি ঠিকই করে যাচ্ছেন এই প্রধান শিক্ষক।
অভিযোগ উঠেছে, উপজেলা দাঁতমারা ইউনিয়নের অন্যান্য এলাকার তুলনায় যোগাযোগের ক্ষেত্রে কিছুটা পিছিয়ে থাকার কারণে এলাকার অনগ্রসর জনগোষ্ঠির দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে বছরের পর বছর ধরে এসব অনিয়ম করে যাচ্ছেন প্রধান শিক্ষক মোমিনুল ইসলাম। তার এসব অনিয়মকে সুকৌশলে বিশেষ সুবিধা নিয়ে বৈধতা দিয়ে আসছেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরাও!। ফলে তার অনিয়মের মাত্রা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। স্কুলের শিক্ষার মানোন্নয়নসহ বরাদ্দ পাওয়া সরকারি অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে তদারকির জন্য গঠিত এসএমসি, স্লিপ ও পিটিআই কমিটির কোন সদস্যকে পাত্তা দেন না তিনি। নিজেই যেন সর্বসর্বা, উল্টো মন্তব্য করেন — ‘সাংবাদিকরা লিখলেও কি হবে’!
বছরের পর বছর বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষকের এমন অনিয়ম আড়ালে থাকলেও একটি ঘটনায় ফাঁস হয়ে গেছে সবকিছু। সম্প্রতি রুস্তম আলী নামের বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে বেদম বেত্রাঘাতের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর ঘটনা অনুসন্ধানে গেলে প্রধান শিক্ষকের এসব অনিয়মের তথ্য বেরিয়ে আসে।
সম্প্রতি স্কুলে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রধান শিক্ষক মোমিনুল ইসলাম অফিসে বসে আছেন। স্কুলের অন্য দুই শিক্ষক ক্লাসে পাঠদানে ব্যস্ত। কিন্তু প্রথম শ্রেণিতে কোন শিক্ষক নেই। এছাড়া প্রাক প্রাথমিকের ক্লাসেও নেই কোন শিক্ষার্থী। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনার নিয়ম মতে প্রাক প্রাথমিকের শ্রেণিকক্ষটি পরিপাটি থাকার কথা। পরে কৌতুহলবশত সরকারি বরাদ্দের স্লিপ এবং রুটিন ম্যান্টেইন্যান্স ফান্ডের অর্থ ব্যয়ের তথ্য চাওয়া হয় প্রধান শিক্ষকের কাছে। আর তখনই বেরিয়ে আসে ‘পুকুর চুরি’র ঘটনা। কাটাছেঁড়া করা একটি প্রাক্কলনের কপি এবং কিছু ভাউচার উপস্থাপন করা হয় এ প্রতিবেদকের সামনে। যা দেখে রীতিমতো চমকে উঠার মত। প্রাক্কলনটিতে আবার উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসার এবং শিক্ষা অফিসারের সীল স্বাক্ষরও রয়েছে।
সেখানে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে বরাদ্দ পাওয়া স্লিপ ফান্ডের ৭০ হাজার টাকা ব্যয়ে নেয়া হয়েছে রীতিমতো পুকুর চুরির আশ্রয়। প্রাক প্রাইমারীসহ ৫টি ক্লাসের ২১৭ জন শিক্ষার্থী দেখিয়ে সরকারি স্লিপ ও রুটিন ম্যান্টেইন্যান্স ফান্ডের টাকা বরাদ্দ নিলেও বাস্তবে স্কুলটিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক কম। কাগজে কলমে মিথ্যা পরিসংখ্যান দিয়ে সরকারি এসব টাকা বরাদ্দ এনে নয় ছয় করেছেন প্রধান শিক্ষক মোমিনুল ইসলাম। এছাড়া প্রত্যেক শ্রেণিকক্ষসহ স্কুলের অফিস কক্ষে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের ছবি, প্রধানমন্ত্রীর ছবিসহ বিখ্যাত মনিষীদের ছবি দেওয়ালে সাঁটানোর নিয়ম থাকলেও ছবিগুলো শ্রেণিকক্ষসহ অফিস কক্ষে স্তুপ করে ফেলে রাকতে দেখা গেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. হোসেন, আবদুর রাজ্জাক,পিন্টুসহ অনেকেই এ ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এসএমসির সহ-সভাপতি মো. মোস্তফা বলেন, প্রধান শিক্ষক নিজের ইচ্ছামত স্কুল পরিচালনা করেন। এসএমসির মিটিং নিয়ম মত করেন না। স্লিপের অর্থ ব্যয়ের বিষয়ে এসএমসির সাথে কোন পরামর্শ করেননি।
এসএমসির এই সদস্য জানান, স্কুলে জাতীয় দিবসগুলোও পালন করা হয় না। এসব বিষয়ে প্রধান শিক্ষককে একাধিকবার তাগাদা দিলেও তা আমলে নেননি তিনি। গত প্রায় ৮ মাস ধরে স্কুলের এসএমসি’র সভাপতি আবু হান্নান বদলিজনিত কারণে অন্যত্র চলে গেলেও ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নিয়োগের বিষয়ে কমিটির মিটিং ডাকা হয়নি।
এ ব্যাপারে মুঠোফোনে আবু হান্নানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, প্রধান শিক্ষকের এসব অনিয়মের বিষয়ে বার বার সতর্ক করা হলেও তিনি তাতে কর্ণপাত করেননি।
এদিকে এতসব অনিয়মের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে প্রধান শিক্ষক মোমিনুল ইসলাম বলেন, উপজেলা শিক্ষা অফিসের নির্দেশক্রমেই সকল কাজ করা হচ্ছে। তিনি কোন ধরনের অনিয়ম করেননি বলেও দাবি করেন।
জানতে চাইলে প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার শরীফুল ইসলাম বলেন, এসব অনিয়মের তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে ।
মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।