চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির নারায়নহাট ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে চলছে অবৈধ বালু উত্তোলন ও পাচারের রমরমা বাণিজ্য। সেই সাথে পাহাড় এবং ফসলি জমির মাটি কেটে চলছে বিক্রির মহোৎসব। এসব বন্ধে মাঝে মাঝে উপজেলা প্রশাসন অভিযান চালালেও চোরা কারবারিরা যেন প্রতিযোগিতায় একধাপ এগিয়ে। বালু ও মাটি খেকোদের সাথে প্রশাসনের চলছে অনেকটা চোর-পুলিশ খেলা। সরকারি খাল, ছড়া এবং জমি থেকে ‘বিশেষ কায়দায়’ এসব বালু উত্তোলন বন্ধে জেলা প্রশাসকের দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার পাচ্ছেন না স্থানীয়রা। মূলত স্থানীয় কিছু প্রভাবশালীর যোগসাজশে চলে এই বালু-মাটির অবৈধ কারবার। যা দিনে দিনে পরিবেশের মারাত্বক বির্পযয় ডেকে আনছে।
সম্প্রতি উপজেলার ভুজপুর থানাধীন এ ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সরকারিভাবে কোন ধরনের ইজারা না থাকলেও থেমে নেই এসব এলাকা থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন। বালুমহালের ইজারা না থাকায় এলাকাভিত্তিক সিন্ডিকেটগুলো অবাধে বালু উত্তোলন ও পাচার করছে। যার ফলে যেমন কোন নিয়ম নীতি মানা হচ্ছে না তেমনি ইজারা না হওয়ায় সরকারও কোন রাজস্ব পাচ্ছে না। এতে করে পরিবেশ ও রাষ্ট্রীয় কোষাগার দুই দিকেই ক্ষতি হচ্ছে।
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ভাঙ্গন প্রতিরোধ এবং বঙ্গবন্ধু মৎস হেরিটেজ খ্যাত হালদা নদীর নারায়নহাটের অংশ বালি উত্তোলনের জন্য ইজারা দেওয়া হয়নি। এছাড়া ইউনিয়নের চাঁনপুর, মাইজকান্দি, হরিনমারা, কাট্টইস্যা, ধামারখীল, বালুখালি ছড়া, কুমারি, শ্বেতছড়া, কুলাল পাড়া এলাকায় নির্ধারিত বালুর মহালগুলো এ বছর সরকারিভাবে ইজারা দেওয়া হয়নি। ইজারা না দেওয়ায় এসব এলাকা বালু উত্তোলনে রয়েছে সরকারি বিধি-নিষেধ। এছাড়া এসব এলাকার কোন কোন জায়গায় কৃষি জমিতেও রয়েছে বালুর উৎস।
স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, দিনের বেলায় বিশেষ কায়দায় বালু উত্তোলন করে স্তুপ করে রাখে পাচারকারী সিন্ডিকেটগুলো। সন্ধ্যার পর থেকেই শুরু হয় বালু পাচারের ‘আঁধার কর্মযজ্ঞ’। চাঁদের গাড়ি (জিপ), পিকআপ, ড্রাম ট্রাক এবং ট্রলিতে করে বালুগুলোপ সরিয়ে ফেলা হয় উত্তোলনের এরলাকা থেকে। পরে ধীরে ধীরে এসব বালু ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে যায়। ভোরের আলো ফোটার আগেই চলে পাচারের এসব কর্মযজ্ঞ। যার ফলে প্রশাসনের লোকজনও নাগাল পায় না!
স্থানীয়রা বলছেন, এই কর্মকাণ্ডে সাথে বড় বড় কর্তারা জড়িত আছেন। জনসম্মুখে এসব লোকের নাম বলতে স্থানীরা শঙ্কিত হলেও তারা বলছেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় মাইজকান্দির দিদার, বেলালসহ আরও বেশ কয়েকজনের নেতৃত্বে চলে এই বালু পাচারের মহোৎসব।
স্থানীয় বেশ কিছু সূত্র বলছে, নারায়নহাটে নির্মাণাধীন সরকারি একটি প্রকল্পে সরবরাহ করা হচ্ছে এসব অবৈধ বালি। ইউনিয়নের মাইজকান্দি, ধামারখীল খীল এলাকার বালুখালি ছড়া এবং আশপাশের জমি থেকে বালি উত্তোলন করে প্রতি ঘনফুট ৩৪ টাকা দরে সরবরাহ করা হচ্ছে প্রকল্পটিতে। স্থানীয় বাজারে সরকারিভাবে ইজারামূল্য দিয়ে উত্তোলিত বালু বিক্রি হচ্ছে ২০-২২ টাকা দরে। অথচ বিদ্যুৎ বিভাগের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে নারায়নহাট বাজারে নির্মানাধীন পিডিবির ১৩৩-৩৪ কেবি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রের নির্মাণ কাজের জন্য এসব অবৈধ বালি ক্রয় করা হচ্ছে ৩৪ টাকা দরে। স্থানীয় এক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এসব বালি সরবরাহ করছেন বলে জানান বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রের নির্মাণ কাজের সংশ্লিষ্টরা।
স্থানীয় যুবলীগ নেতা খোরশেদ আলম মামুন বলেন, অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে জেলা প্রশাসক বরাবরে লিখিত অভিযোগ দিয়েও কোন সুরাহা পাওয়া যায়নি। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আবু জাফর মাহমুদের ছত্রছায়ায় এলাকাভিত্তিক সিন্ডিকেটগুলো প্রতিনিয়ত সক্রিয় রয়েছে বালু ও মাটি পাচারে।
তিনি আরও বলেন, উপজেলা প্রশাসনকেও বিষয়টি বার বার জানানো হয়েছে। সম্প্রতি উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভুমি) অভিযান চালিয়ে ২ জনকে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে সাজা দেয়ার পরেও থামছে না বালু পাচার।
জানতে চাইলে ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবু জাফর মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘কোন ধরনের অবৈধ বালু পাচারের সাথে আমি জড়িত নই। নারায়নহাট এলাকার বালুর মহালগুলো আলোচনা স্বাপেক্ষে ইজারা দেয়ার জন্য আমি উপজেলা মাসিক সমন্বয় সভায় একাধিকবার উপস্থাপন করেছি। কিন্তু নানা কারণে এসব বালুমহাল ইজারা দেওয়া হচ্ছেনা।
তিনি আরও বলেন, এলাকায় উন্নয়ন কাজ করতে হলে বালুর প্রয়োজন রয়েছে। বন্ধ বালুর মহালগুলো ইজারা দিলে সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় হতো। কিন্তু ইজারা না থাকায় বিভিন্ন এলাকায় যে যেভাবে পারছে বালু উত্তোলন করছে ।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাব্বির রাহমান সানি বলেন, হালদা নদী বঙ্গবন্ধু মৎস হেরিটেজ হওয়ায় এটি ইজারা দেওয়ার কোন সুযোগ নেই। এছাড়া অন্যান্য শাখা ছড়াগুলো থেকে বালু পাচার রোধে উপজেলা প্রশাসনের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। ফটিকছড়ি একটি জেলার সমতুল্য উপজেলা। জনবল সংকটের কারণে সব সময় তাৎক্ষণিক অভিযান চালানো সম্ভব হয়না। তবুও নারায়ণহাটের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে অচিরেই এসব অবৈধ বালু পাচার রোধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।