বঙ্গবন্ধু টানেলে দুর্ঘটনা, পুলিশকে রাখা হয়েছে ‘নির্বাক দর্শক’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের ভেতরে কার রেসিং, টানেল সড়কে কার স্টান্ট (গেম বিশেষ যেখানে গাড়ি শূন্যে উঠে পড়ে) এবং গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়ার পরও আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেনি চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ (সিএমপি)। কারণ টানেলে ঢুকতে হলে পুলিশের গাড়িকে টোল দিতে হবে। টোল দেওয়ার মতো অর্থ বরাদ্দ নেই সিএমপির তহবিলে। আইনি জটিলতায় পুলিশ এখনও অবাধে টানেলে প্রবেশের অনুমতি পায়নি। পুলিশের গাড়ি টানেল এলাকার বাইরে রাখতে হচ্ছে।
টানেলের দুই প্রান্তে দুটি থানা স্থাপনের প্রস্তাব থাকলেও তা ঝুলে আছে মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয়ে। দুটি পুলিশ ফাঁড়ি নির্মাণাধীন থাকলেও কাজ শেষ হয়নি। এখন টানেল এলাকার বাইরে অবস্থান নিয়ে আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছে পুলিশকে। কিন্তু যেমন বিলম্ব হচ্ছে তেমনি সব পক্ষকে বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে।

২৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের পরদিন জনসাধারণের জন্য টানেল উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। উন্মুক্ত হওয়ার রাতেই তিনটি অপরাধ সংঘটিত হয় টানেলে। ঘটনার দুই দিন পরও কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। টানেল কর্তৃপক্ষ মামলা করবে বলে পুলিশকে মৌখিকভাবে জানালেও মঙ্গলবার (৩১ অক্টোবর) রাত ৯টায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত অভিযোগ করা হয়নি বলে কর্ণফুলী থানার ওসি মো. জহির হোসেন জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘অভিযোগ পেলেই মামলা হবে।’ একই বিষয়ে টানেলের উপপ্রকল্প পরিচালক মো. আবুল কালাম আজাদ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘টানেলে সংঘটিত অপরাধের বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নিতে উচ্চপর্যায় থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে গাড়িগুলোর নম্বর শনাক্ত করা হয়েছে। মামলার বিষয়ে কথা বলতে কর্মকর্তারা থানায় গেছেন।’
তবে, প্রতিদিনের বাংলাদেশে এই রিপোর্ট প্রকাশের পর বুধবার বেলা সাড়ে ১১টায় খবর নিলে ওসি জানান ‘মামলা হয়নি এখনো।’

২৯ অক্টোবর বিরোধী দলের হরতাল কর্মসূচি থাকায় টানেলে গাড়ির চাপ তুলনামূলক কম ছিল। দিন স্বাভাবিকভাবে কেটে গেলেও রাতে ঘটে বিপত্তি। একদল যুবক কার নিয়ে রেসিং করে টানেলের ভেতরে, যা টানেলের ভেতরে সিসিটিভির ফুটেজে ধরা পড়ে। বাইরে সড়কে গিয়ে করে কার স্টান্ট। আবার টোল প্লাজার কাছে সড়কের আইল্যান্ডের সঙ্গে ধাক্কা লাগে একটি পাজেরো গাড়ির। এই গাড়ির মালিককে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন টানেল কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা বিভাগের সহকারী ব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর আলম।
আবার মঙ্গলবার রাতে একটি প্রাইভেট কারকে পেছন থেকে যাত্রীবাহী বাস থাকা দেওয়ার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

এসব ঘটনায় তাৎক্ষণিক সাড়া দিতে পারেনি পুলিশ। টানেল চালুর পর দুই প্রান্তের কর্ণফুলী ও পতেঙ্গা থানা টহল টিম ও ট্রাফিক বিভাগ একজন সার্জেন্টকে টানেলের আইনশৃঙ্খলা ও ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ-বিষয়ক দায়িত্বে নিয়োজিত করে। কিন্তু দুটি টহল টিম ও সার্জেন্টকে টানেল এলাকার বাইরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে।

পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, পদ্মা সেতু চালুর আগেই দুই প্রান্তে মুন্সীগঞ্জ ও শরীয়তপুরে দুটি নতুন থানার কার্যক্রম চালু হয়। দুই থানার গাড়ি সেতুর নিরাপত্তার প্রয়োজনে টোল ফ্রি করা আছে। দুটি ভিন্ন জেলার অধীনে দুটি থানা হওয়ায় দুই থানার গাড়িকে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তারপরও সেতুর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নির্বিঘ্ন রাখার স্বার্থে সরকার সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করে। একইভাবে বঙ্গবন্ধু সেতুর দুই প্রান্তে টাঙ্গাইল এবং সিরাজগঞ্জ জেলার দুই থানার গাড়ি টোল ফ্রি সেতু পারাপারের সুযোগ পায়। সেখানে দুই জেলার দুটি ইউনিটের পুলিশ টোল ফ্রি পারাপারের সুযোগ পেলেও কর্ণফুলী টানেলে সেই সুযোগ রাখা হয়নি।

আবার পদ্মা সেতু ও বঙ্গবন্ধু সেতু ভিন্ন জেলার সংযোগ সেতু হলেও বঙ্গবন্ধু টানেল শুধু চট্টগ্রাম মহানগর এলাকাভুক্ত। কর্ণফুলী নদীর পূর্ব প্রান্তের কর্ণফুলী থানা এবং পশ্চিম প্রান্তের পতেঙ্গা থানা এক ইউনিটের অধীনে। তাই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে ট্রাফিক ও পুলিশ টহলের গাড়ি যাতায়াত করতে হয়। যেমনটা যাতায়াত করে একই নদীর ওপর নির্মিত শাহ আমানত সেতুর ওপর দিয়ে। ওই সেতু এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশের গাড়িকে টোল দিতে হয় না। কিন্তু নতুন চালু হওয়া টানেলে টোল ফ্রি সুবিধা চালু করা হয়নি। আবার টোলের অর্থ পরিশোধের জন্য সরকারি অর্থ বরাদ্দও নেই সিএমপির তহবিলে। ফলে টানেল এলাকার বাইরে নীরব দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই পুলিশের।

সিএমপি থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ‘বঙ্গবন্ধু টানেল পূর্ব’ ও ‘বঙ্গবন্ধু টানেল পশ্চিম’ নামে দুটিসহ মোট চারটি থানা স্থাপনের জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল পুলিশ সদর দপ্তরে। যাচাই-বাছাইয়ের পর সেই প্রস্তাবটি ২০২২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিবের কাছে যায়। এর প্রায় ২০ মাস পরও থানা চারটি গঠনের প্রস্তাব অনুমোদন পায়নি।

টানেলের ভেতর ও বাইরে সংঘটিত অপরাধের বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে টানেলের উপপ্রকল্প পরিচালক মো. আবুল কালাম আজাদ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘টানেলের ভেতরে রেসিং করা গাড়িগুলোর নম্বর এরই মধ্যে শনাক্ত করা হয়েছে। এই বিষয়ে মামলার প্রক্রিয়া চলছে।’ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত পুলিশের গাড়ির টোল ফ্রি ব্যবস্থা না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দুই প্রান্তের দুই থানার গাড়ির নম্বর চাওয়া হয়েছে। গাড়ির নম্বর পেলে টোল ফ্রি করার ব্যবস্থা করা হবে।’ তবে পুলিশ আগেই সব কাগজপত্র দিয়ে রেখেছে বলে জানিয়েছে।

সৌজন্যে: প্রতিদিনের বাংলাদেশ

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।