১৬ দিন আগেও দীর্ঘ যানজটের ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে অ্যাম্বুন্সেসে থাকা রোগীসহ বিভিন্ন যানবাহনের যাত্রীদের। দীর্ঘ কয়েক কিলোমিটারের যানজটের ভোগান্তির শিকার হয়েছেন দক্ষিণ চট্টগ্রামের লক্ষাধিক মানুষ। তবে সে দৃশ্য এখন অদৃশ্য হয়ে গেছে নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের কারণে। সন্ধ্যার পর গাড়ির চাপ বাড়তে থাকলেও সড়কের যানজটে পড়তে হচ্ছে না কাউকে। সড়কে যানবাহনের উপস্থিতি বাড়লে যাত্রীর ভিড় দেখা যায়নি। চোখে পড়েনি কোথাও যানজট। গত ১৬ দিনে পাল্টে গেছে চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও কর্ণফুলীর মানুষের জীবনমান।
জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু টালেন দিয়ে উত্তরবঙ্গসহ দেশের বিভিন্নস্থান থেকে গরু-মহিষবাহী ট্রাক অল্প সময়ে ঢুকে যাচ্ছে চট্টগ্রামের আনোয়ারার তৈলারদ্বীপ সরকার হাটে। আসছে বিভিন্ন পণ্যও। সাশ্রয় হচ্ছে জ্বালানি খরচ, কমেছে সড়কে চাঁদাবাজি। গত এক সপ্তাহে প্রায় ৭ কোটি টাকার পশু বিক্রি হয়েছে বলে জানায় হাট ইজারাদার।
এদিকে দর্শনার্থীর ও সাধারণ যাত্রীদের চাপ সামলাতে আনোয়ারা প্রান্ত থেকে পতেঙ্গা ইপিজেড পর্যন্ত বাস সার্ভিস চালুর জন্য ৩০টি বাসের পারমিট চেয়ে আবেদন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে আনোয়ারা-পটিয়া-বাঁশখালী (পিএবি) সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি জাফর উদ্দিন চৌধুরী।
ট্রাফিক পুলিশের ইনচার্জ হাফিজুর রহমান বলেন, পণ্যবাহী বা শহরের যাত্রীবাহী বেশিভাগ গাড়িই টানেল দিয়ে সহজে পার হচ্ছে। পোষাক কারখানার শ্রমিকবাহী গাড়ি গুলো বৈরাগ দিয়ে টানেল সড়কে যাতায়াত করছেন। নতুন ব্রিজ পর্যন্ত আগে যেসব গাড়ির চাপ ছিলো সেগুলো অনেকটায় কমে গেছে। সে সঙ্গে বাজারের মূল ফটকে যে যানজটটি লেগে থাকত; ট্রাফিক পুলিশের নিজ উদ্যোগে সড়কে মাঝখানে আইল্যান্ড দেওয়া হয়েছে। এতে কমেছে দুর্ঘটনা, আর নেই যানজট।
পাল্টাচ্ছে জীবনমান
কর্ণফুলী নদীকে যুক্ত করে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ স্বপ্ন থেকে গত ২৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। চালুর পর মাত্র ১৫ দিনে বদলে গেছে এলাকার চিত্র। ঢাকা থেকে কক্সবাজার যেতে আগে কম করে হলেও ৯ ঘন্টা সময় লাগত। এখন চট্টগ্রাম শহর থেকে টানেল হয়ে আনোয়ারা কালাবিবির দিঘি পর্যন্ত মাত্র সাত কিলোমিটারে চার লেনের সড়ক কমিয়ে দিয়ে ঢাকা কক্সবাজারের ৫০ কিলোমিটার দুরত্ব কমেছে। ফৌজদারহাট বাইপাস হয়ে টানেলে ঢুকে মাত্র ৭ ঘন্টায় পৌঁছা যাচ্ছে দেশের প্রান্ত সীমায়। মাতার বাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর, কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে মালামাল পরিবহনে অনেক বেশি সহজ। পূর্বমুখি দিগন্ত উম্মোচনে এশিয়ান সড়ক নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
অর্থনৈতিক সম্ভাবনা থেকে আনোয়ারা প্রান্তে গড়ে উঠেছে শতাধিক নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। চালু হওয়ার অপেক্ষায় অন্তত ৩টি শিল্প কারখানা। কারাবিবির দীঘি এলাকা হয়ে উঠেছে নতুন বাণিজ্যিকপাড়া। বেঙ্গল ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী, যমুনা ব্যাংক, আইএফআইসি, কমার্স ব্যাংক ইতিমধ্যে তাদের শাখা খুলেছে। চালুর অপেক্ষায় আছে এনসিসি ব্যাংক ও ট্রাস্ট ব্যাংকের দুটি শাখা।
স্থানীয় বৃদ্ধ জবির আহমদ বলেন, পতেঙ্গা থেকে আনোয়ারা প্রান্তে আসা তিনঘন্টার পথ ছিলো, এখন কয়েক মিনিটের মধ্যে আমরা চলে আসতেছি। বিমানবন্দর থেকে পুরো শহর ঘুরে বাড়ি যেতে হলে ঘন্টা দেড়েক সময় বেশি লাগত। এখন এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে মাত্র ১০ মিনিটে টালেন পার হয়ে আনোয়ারা প্রান্তে। সত্যিই এ যেন স্বপ্নের মতই। ধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এত সুন্দর টানেল উপহার দেওয়ার জন্য।
স্থানীয় বাসিন্দা ব্যাংক কর্মকর্তা মাসুদ বিন জাফর বলেন, বঙ্গবন্ধু টানেল এখন জানান দিচ্ছে অপার সম্ভাবনার। টানেলকে কেন্দ্র করে দক্ষিণের দ্বার খ্যাত আনোয়ারা ও কর্ণফুলীতে গড়ে উঠেছে নতুন-নতুন শিল্প কলকারখানা ও ব্যাংকের শাখা-উপশাখা। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে এ জনপদে হচ্ছে আধুনিক সব বাণিজ্যিক উদ্যোগ। প্রসার ঘটবে ব্যবসা-বাণিজ্যের, সুযোগ তৈরী হবে আত্মকর্মসংস্থানের।
বেসরকারি এনসিসি ব্যাংক লিমিটেডের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান এস.এম আবু মহসীন বলেন, টানেল কেন্দ্রীক ব্যবসায়িক সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে আনোয়ারায় ব্যাংকের নতুন-নতুন শাখা হচ্ছে। আগামী দিনে কর্ণফুলীর দক্ষিণ তীরের এই এলাকাটি হবে ব্যবসা বাণিজ্যের নতুন প্রাণকেন্দ্র। এটি কক্সবাজার পর্যন্ত বিশাল অর্থনৈতিক করিডোরের স্বপ্ন দেখাচ্ছে।
টানেল চালুর পর দুই সপ্তাহের পর্যবেক্ষণের আলোকে শিক্ষাবিদ ও গবেষক প্রদীপ চক্রবর্তী বলেন, টানেল কেন্দ্রীক অর্থনৈতিক টার্নওভার ১৫ দিনে শত কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এখানকার ব্যাংকের ৫ শাখায় ১৫ দিনে গ্রাহকের লেনদেন হয়েছে প্রায় ৩০ কোটি টাকা। জমি বেচাকেনা হয়েছে ১৫ কোটি টাকা, হোটেল- রেস্টুরেন্টে বিক্রি ৮ কোটি টাকা, টোল আদায় ২ কোটি, সরকার হাট গরু বাজারে পশু বিক্রি ১৫ কোটি। শাক সবজি, পরিবহণ, দোকানের সওদাপাতি থেকে যোগ হয়েছে আরও প্রায় ৩০ কোটি টাকা। যত দিন যাবে তা আরো বাড়বে।
অবরোধ-হরতালসহ নানা কর্মসূচির মধ্যে বঙ্গবন্ধু টানেল দিয়ে মাত্র ১৬ দিনে গাড়ি পারাপার ছুঁয়েছে ৮৯ হাজার ৩২৮টি যানবাহনে। এসব যানবাহনের কাছ থেকে টানেল ব্যবহারের বিপরীতে টোল আদাল করা হয়েছে ২ কোটি ৫ লাখ ৮২ হাজার টাকা। টোল আদায়েরর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল কর্তৃপক্ষের সহকারী প্রকৌশলী তানভীর রিফা।
বঙ্গবন্ধু টানেল ঘিরে বৃহত্তর অর্থনৈতিক জোন গড়তে আসছে সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার চার লেনের জাতীয় মহাসড়ক করার পরিকল্পনা। গত ৩১ অক্টোবর জাতীয় অর্থনৈতিক নির্বাহী পরিষদের (একনেক) বৈঠকে প্রকল্পটি অনুমোদন পেয়েছে। এ প্রকল্পে পটিয়া, দোহাজারী, লোহাগাড়া ও চকরিয়ায় বাইপাস এবং কেরানিহাটে ফ্লাইওভারসহ পাঁচ পয়েন্টে ২৬ কিলোমিটার সড়ক চার লেনে উন্নীত হবে। টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষে আর মাত্র দুই মাস পর ১ জানুয়ারি থেকে কাজ শুরু করা হবে বলেও জানা গেছে।
আনোয়ারা উপজেলা সাব রেজিষ্ট্রার রেজাউল করিম বলেন, এক মাসে ৪৮৭টি দলিল রেজিষ্ট্রি হয়েছে। সরকার রাজস্ব পেয়েছে ২৫ লক্ষ ৮৭ হাজার টাকা। এসব দলিলের অফিসিয়াল মূল্য প্রায় ১৫ কোটি টাকা। কাগজে কলমের এই মূল্যের তুলনায় বাস্তবে বিক্রিত জমির দাম দ্বিগুণ।
চন্দনাইশ আনোয়ারার সীমান্তবর্তী সাংঙ্গু তীরের সবজি ভাণ্ডার কিংবা চন্দনাইশের বিখ্যাত পেয়ারা এতদিন বড়জোর চট্টগ্রামের বাজার পর্যন্ত নাগাল পেত। কর্ণফুলী সেতু পেরিয়ে যানজট ঠেলে চট্টগ্রাম যেতে যে ভোগান্তি ছিল, একই সময়ে টানেল হয়ে অনেকে ঢাকা পৌঁছে যাচ্ছেন। তাতেই হাসি প্রচারিত হচ্ছে সবজি চাষীদের। আনোয়ারা, বাঁশখালী, চন্দনাইশের মিঠাপানির মাছের খ্যাতি আছে আশপাশের এলাকায়।
কর্ণফুলী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান ফারুক চৌধুরী বলেন, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণপাড় মডেল উপশহরে পরিণত হয়েছে। আনোয়ারা ও কর্ণফুলী আশপাশের এলাকাটি এখন দেখে চেনার উপায় নাই। বঙ্গবন্ধু টানেলের কারণে পাল্টে গেছে দু’অঞ্চলের জীবনমানও।
ভূমিমন্ত্রী ও আনোয়ারা-কর্ণফুলী থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের কারণে পাল্টে গেছে কর্ণফুলীর দক্ষিণ তীরের চিত্র। এর সুফল সুদূরপ্রসারী। আর কয়েক বছর গেলে আরো স্পষ্ট হবে, এই এই অঞ্চলের মানুষের জন্য কত বড় সম্পদ। কক্সবাজার পর্যন্ত বিশাল অর্থনৈতিক অঞ্চল এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।