বেকারত্ব দূরীকরণে ভূমিকা রাখবে ‘দক্ষতার উন্নয়ন’—আবুবকর হানিপ

দেশের বাইরে বাংলোদেশি হিসেবে পূর্ণাঙ্গ কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) সাবেক শিক্ষার্থী ইঞ্জিনিয়ার আবুবকর হানিপ। যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় তার মালিকানাধীন ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (ডব্লিউইউএসটি) বিদেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের আগ্রহের স্থান দখল করে নিয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়টির কর্মমুখী শিক্ষাই মূলত শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করছে। ইঞ্জিনিয়ার আবুবকর হানিপ বিশ্ববিদ্যালয়টির মালিকানা নেওয়ার পর এ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন। শুধু উচ্চশিক্ষা নয় বিশ্ববিদ্যালয়টি বাংলাদেশি ছাত্রদের চাকরির ব্যবস্থাও করেছে। ১২১টি দেশের প্রায় এক হাজার শিক্ষার্থী এখন আইসিটি এবং সাইবার সিকিউরিটিসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পড়াশোনা করছেন ডব্লিউইউএসটিতে যেখানে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর রয়েছে পাঁচ শতাধিক।
গত ১৭ বছরে ইঞ্জিনিয়ার আবুবকর হানিপ সাত হাজার বাংলাদেশির উচ্চ শিক্ষার পাশাপাশি দক্ষতা বিকাশে সহায়তা করেছেন এবং আমেরিকান সংস্থাগুলিতে চাকরি পেতে যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলেছেন। একসময় যারা বছরে আয় করতো কেবল ৪০ হাজার ডলার এখন তারা বছরে গড়ে আয় করছেন লাখ ডলার কিংবা তারও বেশী। ডব্লিউইউএসটি থেকে উচ্চশিক্ষা ও প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনের পরই শিক্ষার্থীরা তাদের মাসিক আয় দ্বিগুণ করতে সক্ষম হয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়াতে চট্টগ্রাম খবরের পক্ষ থেকে চ্যান্সেলর আবুবকর হানিপের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন আমাদের নির্বাহী সম্পাদক শেখ মো. আকিজ। চট্টগ্রাম খবরের পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো—

বাংলাদেশে পড়াশোনা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ভাবনা আপনার মনে কীভাবে জন্মালো?
চ্যান্সেলর আবুবকর হানিপ—আমেরিকার শিক্ষার্থীদের স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পূর্ণ করতে প্রায় ৬০ হাজার থেকে ১ লাখ ডলার খরচ হয়। বর্তমানে আমেরিকায় শিক্ষার্থীদের মোট ঋণের পরিমাণ ২ ট্রিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে বেসরকারি ঋণের পরিমাণ ৩০০ বিলিয়ন এবং সরকারি ঋণ ১.৭ ট্রিলিয়ন ডলার।
ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে, হাজার হাজার ডলার ব্যায় করে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা শেষ করে জব পেতে নানা সমস্যায় পড়েন। আর তার পেছনে অন্যতম কারণ দক্ষতার অভাব। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার সাথে সাথে দক্ষতার বিকাশ ঘটাতেই আমার এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা—যোগ করেন ইঞ্জিনিয়ার হানিপ।
আমেরিকান সরকার প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে কমপক্ষে ৮৫ হাজার দক্ষ লোক নিয়োগ করে। আমি ভেবেছি যদি আমরা শ্রেণীকক্ষেই এই দক্ষতার ঘাটতি পূরণ করতে শুরু করতে পারি তবে এটি ভালো ফলাফল এনে দিতে পারে। আমাদের এখানে শিক্ষার্থীদের কর্মমুখী শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। যার ফলে তারা এন্ট্রি-লেভেল থেকে মিড লেভেল পর্যন্ত চাকরি পাবে এবং সনদও মিলবে। এই লক্ষ্য নিয়েই আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব নিয়েছি।

যুক্তরাষ্ট্রের মতো জায়গায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানা কতটুকু চ্যালেঞ্জিং ছিলো?
চ্যান্সেলর আবুবকর হানিপ—চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) থেকে ডিগ্রি নিয়ে আমেরিকায় চলে আসি। কম্পিউটার সায়েন্সে থেকে জিপিএ ৪.০৫ পেয়েও আমেরিকায় এসে কোন চাকরি মিলেনি। তখন আমাকে ঘন্টায় ৫ ডলার করে কাজ করতে হয়েছে।
এরপর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দক্ষতা উন্নয়নের ওপর প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করি। একটি মোটামুটি মানের চাকুরিতে প্রবেশ করে আমি বুঝতে পারি পড়াশোনার সাথে সাথে দক্ষতার উন্নয়ন কতটা জরুরী। তখন বাংলাদেশিদের জন্য আমি একটি প্রতিষ্ঠান শুরু করি । যেখানে প্রায় ৩০০ বাংলাদেশিকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর আমি তাদের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির ব্যবস্থা করেছি।
তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে গেছে সেই প্রতিষ্ঠান। একটা সময় এসে নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্নটাও পূরণ হয়।

ডব্লিউইউএসটি বাস্তবধর্মী শিক্ষা দেয়—
ওয়াশিংটন ডিসিতে ২০০৮ সালে আইগ্লোবাল ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে আমি ২০২১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টি ১০০ কোটি টাকায় কিনেছিলাম এবং এর নাম দিয়েছিলাম ‘ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’। আমি যখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানায় আসি তখন এর শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল মাত্র ৩০০। দুই বছরের ব্যবধানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এখন এক হাজার ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে ৫ শতাধিক শিক্ষার্থী বাংলাদেশি।
আমরা প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে বাস্তব জীবনের পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে এবং বিনোদনের মাধ্যমে শিক্ষা দিই যাতে শিক্ষার্থীরা এখান থেকে কর্পোরেট জ্ঞান অর্জন করতে পারে। আর বাংলাদেশে ফিরে গেলে তারা দেশের বড় বড় প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানিগুলোর নেতৃত্ব দিতে পারবে। অন্যদিকে, তারা যদি আমেরিকায় থাকতে চায় তবে তারা এখানে বড় কোম্পানির নেতৃত্বও ধরে রাখতে পারে।
বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ১২১টি দেশের ১ হাজার শিক্ষার্থী আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছে। এর মধ্যে বাংলাদেশিদের সংখ্যাই বেশি। বেশি বাংলাদেশি ছাত্র থাকার কারণ হল আমি প্রতিষ্ঠানটি কেনার পরপরই আমি তাদের স্কলারশিপ দিচ্ছি। আমি চাই আমার দেশের শিক্ষার্থীরা দেশে ও বিদেশে অবদান রাখুক।

বেকারত্ব দূরীকরণে ভূমিকা রাখবে ‘দক্ষতার উন্নয়ন’—আবুবকর হানিপ 1

ডব্লিউইউএসটিতে ভর্তি হতে কী করতে হবে?
চ্যান্সেলর আবুবকর হানিপ—আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ, এমবিএ, বিএসআইটি, এমএসআইটি, মাস্টার্স এবং সাইবার সিকিউরিটিজ এবং সাইবার সিকিউরিটিতে ব্যাচেলর এর মতো কোর্স রয়েছে। যেকোনো ব্যাকগ্রাউন্ডের শিক্ষার্থীরা এমবিএ প্রোগ্রামের জন্য আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে পারে।
আমেরিকান এমবিএ ডিগ্রি এখানে সবকিছুর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এমবিএ কোর্সের আগে আপনার আইইএলটিএস, ডুওলিঙ্গো অন্য যেকোনো ইংরেজি দক্ষতার সনদ থাকতে হবে। আইইএলটিএস স্কোর ৫.৫ এর কম হবে না এবং ডুওলিঙ্গো এর জন্য একজনকে ৯০ স্কোর করতে হবে।
আইইএলটিএস এবং ডুওলিঙ্গো শেষ করার পর আমরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অফার লেটার পাঠাই। এরপর শিক্ষার্থীকে আমেরিকায় আসার আগে মার্কিন দূতাবাসের মুখোমুখি হতে হয়।
তিনি বলেন, ২০২০ সালের জানুয়ারির আগে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ ১০ জন। কিন্তু ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসের পর এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫’শর বেশি। এখন ভিসা পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়েছে।

ডব্লিউইউএসটিতে পড়ার খরচ কেমন?
চ্যান্সেলর আবুবকর হানিপ—আমাদের টিউশন ফি খুবই যুক্তিসঙ্গত। দুই বছরের মাস্টার্স ডিগ্রির জন্য এখানে ২২ হাজার ৬‘শ ডলার প্রয়োজন। যদি স্টাইপেন্ড দেওয়া হয় তবে ১৫ হাজার। আমাদের দক্ষতা বিকাশের জন্য আরেকটি প্রতিষ্ঠান ‘পিপল অ্যান্ড টেক ইনস্টিটিউট’ রয়েছে যেখানে আমরা ৫ হাজার ডলারের বিনিময়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। এই কোর্সটি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে দেওয়া হয়। তার মানে একজন ছাত্রকে মাস্টার্স ডিগ্রির জন্য ১০ হাজার ডলার খরচ করতে হবে।
অন্যদিকে, যদি কেউ ব্যাচেলর ডিগ্রির জন্য আসে তবে তাকে চার বছরে ৫৬ হাজার ডলার খরচ করতে হবে। যদি তাকে স্কলারশীপ দেওয়া হয় তাহলে চার বছরে মোট ৪৪ হাজার ডলার খরচ হবে। যারা ব্যাচেলর ইন বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন প্রোগ্রামের জন্য আসেন তাদের সরাসরি ৫০ শতাংশ স্কলারশীপ দেওয়া হয়। যার ফলে ৪ বছরে ২৮ হাজার ডলার খরচ হয়।

বেকারত্ব দূরীকরণে ভূমিকা রাখবে ‘দক্ষতার উন্নয়ন’—আবুবকর হানিপ 2
ডব্লিউইউএসটি’র কনভোকেশন ২০২২-এ শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাস

পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরির সম্ভাবনা কেমন?
চ্যান্সেলর আবুবকর হানিপ—একজন শিক্ষার্থী তার পড়াশোনার পাশাপাশি সপ্তাহে ২০ ঘন্টা কাজ করতে পারবে। আমরা তাদের ক্যাম্পাসে ২০ ঘন্টার চাকরি দিতে পারি। যেহেতু তারা দক্ষতা ভিত্তিক শিক্ষা শিখছে তাই তাদের শিক্ষার ওপর ফোকাস করতে হবে। কারণ বিনিয়োগের প্রচুর রিটার্ন রয়েছে।
আমরা ঐচ্ছিক ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে একজনকে চাকরিতে যোগ দিতে হবে। যদি কেউ চাকরি পেতে ব্যর্থ হয় তবে তাকে দেশে ফিরে যেতে হবে বা অন্য মাস্টার্স প্রোগ্রাম করতে হবে। তবে ভালো খবর হলো আমি এ প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা শুরু করার পর প্রায় ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে চাকরি পেতে সক্ষম হয়েছে।

ডব্লিউইউএসটির পাঠ্যক্রম কতটা উপযোগী?
চ্যান্সেলর আবুবকর হানিপ—আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম মডিউল বিশ্বের অন্যসব বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শুধু ডিগ্রি প্রদান করে থাকে এবং তারপর শিক্ষার্থীদের নিজ দায়িত্বে চাকরি খুঁজতে হয়। কিন্তু আমরা সরাসরি মধ্য বা সিনিয়র লেভেলের চাকরি পেতে সাহায্য করছি।

ডব্লিউইউএসটি থেকে পড়াশোনা করে বাংলাদেশিরা কীভাবে দেশের অগ্রগতিতে অবদান রাখবে?
চ্যান্সেলর আবুবকর হানিপ—বাংলাদেশিদের মধ্যে যারা বছরে ৫০ হাজার ডলার আয় করত তারা এখন ১ লাখ ৫০ হাজার ডলার আয় করছে। আমি যদি ধরে নিই যে আমি এখন পর্যন্ত ৭ হাজার বাংলাদেশির জন্য চাকরির ব্যবস্থা করেছি এবং তাদের প্রত্যেকে যদি গড়ে ১ লাখ ডলার উপার্জন করে তাহলে তারা এখন বছরে ৭০০ মিলিয়ন ডলার আয় করছে। আর তাদের আয়ের মাত্র ২০ শতাংশ বাংলাদেশে গেলেও তা বড় অঙ্কের রেমিট্যান্স দাঁড়ায়।
আমরা বাংলাদেশেও এই মডিউলটি প্রয়োগ করতে পারি যেখানে মোট ১৬৩টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে ৮টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৫৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। ওইসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আসা শিক্ষার্থীরা কি চাকরি পাচ্ছে?
বাংলাদেশে শিক্ষার শিক্ষার্থীরা ভালো চাকরি পায় না। সবাই এখন বিসিএস পরীক্ষায় বসতে চায়। একজন এমবিবিএস ডাক্তার বিসিএস পরীক্ষার পর পুলিশ সুপার হন। ফলে আমার মনে হয়, জ্ঞানের বিশেষ শাখায় উচ্চশিক্ষার জন্য সরকার যে ভর্তুকি দিচ্ছে তা নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের দক্ষতা উন্নয়ন শেখানো হলে কেউ বেকার থাকবে না।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।