ভাবনায় ভরা বিজ্ঞান মেলা

জলাবদ্ধতা নিরসনে আন্ডার রোড ড্রেনেজ সিস্টেম, ইলেকট্রনিক পোলট্রি ফার্ম, মেডিসিন মেশিন, নিরাপদ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নিরাপদ রেলওয়ে সিস্টেম ও পাহাড়ি রাস্তায় নিরাপদ যান চলাচলের জন্য সেন্সর সিস্টেম—এ রকম আরও অনেক ভাবনায় সমৃদ্ধ উদ্ভাবন নিয়ে টানা তৃতীয় বারের মতো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) আয়োজিত হয়েছে চট্টগ্রাম সাইন্স কার্নিভাল ৩.০। ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের তৈরি এসব উদ্ভাবন যেমন বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের উপায় খুঁজে দিচ্ছে তেমনি যেন ভবিষ্যতে এক মেধবী প্রজন্ম তৈরির আগাম আভাস দিচ্ছে।

বৃহস্পতিবার (১৫ জুন) বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান অনুষদে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সায়েন্টিফিক সোসাইটির (সিইউএসএস) উদ্যোগে আয়োজিত হয় এই অনুষ্ঠান। আয়োজনে ছিলো পোস্টার প্রেজেন্টেশন, প্রজেক্ট শোকেসিং, হ্যাকাথন, রোবো সকার কম্পিটিশন, রেইন স্ট্রমিং, কুইজ প্রভৃতি সেগমেন্ট। স্কুল, কলেজ ও ৩১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি প্রফেশনালরাও অংশগ্রহণ করেন বিজ্ঞান মেলায়।

সারাদেশের ৬১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সহস্রাধিক শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন এ আয়োজনে। প্রতিটি সেগমেন্টে বিজয়ীদের জন্য পৃথক ক্যাটাগরীতে পুরষ্কারসহ প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের জন্য ১ লাখ ১১ হাজার টাকার আর্থিক পুরস্কারও দেওয়া হয়।

চট্টগ্রাম নগরীতে বেড়ে ওঠা জয়দ্বীপ চৌধুরী, রোহিত বিশ্বাস ও অমিত দে ‘রা খুব কাছ থেকেই দেখেছেন জলাবদ্ধতার চিত্র। নগরীর জলাবদ্ধতার সমস্যা তাদেরও ভাবিয়েছে। আর তাইতো চট্টগ্রাম সাইন্স কার্নিভালে হাজির হোন এর সমাধান নিয়ে। তাদের মতে নগরীর মুরাদপুর, বহদ্দারহাটসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন স্থানের জলাবদ্ধতা নিরসনে কার্যকরী ভূমিকা রাখবে এই প্রজেক্ট।

চট্টগ্রামের সেন্ট প্লাসিড’স স্কুল এন্ড কলেজে পড়ুয়া এসব শিক্ষার্থীরা বলেন, আমাদের এই প্রজেক্টের আওতায় ড্রেনেজ সিস্টেম থাকবে রাস্তার নিচে। রাস্তায় জমা বৃষ্টির পানি এই ড্রেনে গিয়ে পড়বে। পরে সেটা নদী বা জলাশয়ে অপসারণের ব্যবস্থা করা হবে। এতে জলাবদ্ধতা তৈরির সম্ভাবনা থাকবে না।

তারা আরও বলেন, আমাদের আরও কিছু প্রজেক্ট আছে। এসব প্রজেক্ট বাস্তবায়িত হলে দেশের নানান সমস্যা সমাধান হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন এই উদীয়মান কিশোররা। সেই সাথে সামনে নিজেদের চিন্তার প্রসার ঘটিয়ে বড় বড় বিষয় উদ্ভাবনের স্বপ্নও দেখেন এই ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা।

জয়দ্বীপ, রোহিত ও অমিতদের মতো আরও অনেকে এদিন নিজেদের উদ্ভাবন নিয়ে হাজির হয়। যা রাঙিয়ে তোলে চট্টগ্রাম সাইন্স কার্নিভাল ৩.০। আশা জাগায় এক মেধবী ভবিষ্যৎ প্রজন্মের।

সরেজমিনে দেখা যায়, বিজ্ঞান মেলার স্ক্রিন পরিক্ষারে একটি স্টল বসে। যেখানে ছিলো শিক্ষার্থী দের উপচে পড়া ভিড়। শিক্ষার্থীদের স্ক্রিন পরিক্ষা করে, স্ক্রিন ভালো রাখতে বিভিন্ন পরামর্শ ও ওষুধ লিখে দিচ্ছিলেন তারা। এই স্টলে শুধু মেয়েদের স্ক্রিন পরিক্ষা করা হয়েছিল। দুপুরের দিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এই স্টল থেকে নিজের স্ক্রিন পরিক্ষা করে নেন। পরিক্ষা শেষ তিনি এরকম উদ্যেগের প্রশংসা করেন। এছাড়া শিক্ষার্থীদের তৈরি পাথরের মধ্যে বৃক্ষরোপণ এবং বৃক্ষে পানি দেওয়ার জন্য একুরিয়াম থেকে তৈরি নাইট্রোজেনের মতো বিষয়গুলো সবার নজর কেড়েছে।

এদিন সকাল ১১টায় চবির সমাজ বিজ্ঞান অনুষদ মিলনায়তনে আলোচনা সভার মধ্য দিয়ে শুরু হয় এর আনুষ্ঠানিকতা। সিইউএসএসেরর সভাপতি মিজানুর রহমান শিহাবের সভাপতিত্বে এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার। সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন চবি উপ-উপাচার্য অধ্যাপক বেনু কুমার দে, বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ নাসিম হাসান, সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সিরাজ উদ দৌল্লাহ, আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ আল ফারুক, জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. তৌহিদ হোসেন, চবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমান ছিদ্দিকী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাইন্টিফিক সোসাইটির উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আল-ফোরকান, উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. লায়লা খালেদা (আঁখি)।

ভাবনায় ভরা বিজ্ঞান মেলা 1

প্রধান অতিথির বক্তব্যে চবি উপাচার্য বলেন, কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানভীতি দূর করতে এ মেলা অত্যন্ত কার্যকর এবং ফলপ্রসু ভূমিকা রাখবে। আমাদের শিক্ষার্থীরা অত্যন্ত মেধাবী ও সম্ভাবনাময়। তাদেরকে প্রযুক্তি নির্ভর আধুনিক শিক্ষায় গড়ে তুলতে পারলে একদিকে যেমন ভবিষ্যতে তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ ঘটবে অন্যদিকে দেশ-জাতি উপকৃত হবে।

চবি উপ-উপাচার্য অধ্যাপক বেনু কুমার দে বলেন, বর্তমানে প্লাস্টিকের কারণে পরিবেশ দূষণ অতি মাত্রায় বেড়ে গেছে। প্রতিনিয়ত প্লাস্টিক আমরা সবাই ব্যবহার করি। অতিমাত্রায় প্লাস্টিক ব্যবহারের কারণে এখন তা পৃথিবীর জন্য হুমকি হয়ে দাড়িয়েছে। এখন বিজ্ঞানীদের উচিত কিভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এই প্লাস্টিক ডি-কম্পোজড করে পরিবেশের ক্ষতি কমিয়ে আনা যায় তার একটি পদ্ধতি বের করা।

ভাবনায় ভরা বিজ্ঞান মেলা 2

অনুষ্ঠানের ২য় পর্বে ‘নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এতে মূখ্য আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সৌরশক্তি গবেষক ও বিজ্ঞানী এবং ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স এন্ড টেকনোলজি চিটাগং এর উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. নওশাদ আমিন।

তিনি বলেন, বর্তমানে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের পৃথিবীর তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বাড়ছে। মেরু অঞ্চলের বরফ গলে গিয়ে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের উচিত সৌরশক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করা। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে সম্প্রতি সৌরশক্তির ব্যবহার ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, পারমানবিক শক্তি সর্বদা হুমকিস্বরূপ। জাপানের ফুকুশিমায় পারমাণবিক বিপর্যয় তার উদাহরণ। কিন্তু, সৌরশক্তি হলো পরিবেশবান্ধব। বর্তমানে সৌরশক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ পারমাণবিক শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচের তুলনায় অনেক কম। তাই, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে।

এছাড়াও এদিন সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের সম্মেলন কক্ষ ও ড. মোহাম্মদ আনিসুজ্জামান সেমিনার কক্ষে অনুষ্ঠিত হয় ক্ষুদে বিজ্ঞানীদের প্রজেক্ট প্রদর্শন। সমগ্র এই আয়োজনের পৃষ্ঠপোষক ছিল বায়োজিন কসমেসিউটিক্যালস ও বসুন্ধরা অয়েল এন্ড গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।