চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে রপ্তানি জালিয়াতির মাধ্যমে পোশাক রপ্তানিকারক ১০টি প্রতিষ্ঠান ১২৩৪টি পণ্যচালানে জালিয়াতির মাধ্যমে অন্তত ৩০০ কোটি টাকা পাচার করেছে বলে জানিয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো বিল অব এক্সপোর্ট জালিয়াতি করে অন্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের ইএক্সপি ব্যবহার করে পণ্য রপ্তানি করেছে। বিল অব এক্সপোর্টের ২৪ নং কলামে নমুনার কোড ২০ ব্যবহার করেছে। এক্ষেত্রে কোনো অর্থ দেশে প্রত্যাবাসিত না হয়ে সমুদয় রপ্তানি মূল্য বাবদ অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে।
সোমবার (৪ সেপ্টেম্বর) গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের যুগ্ম পরিচালক মো. শামসুল আরেফিন খান বিষয়টি নিশ্চিত করেন। শুল্ক গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, অভিনব কায়দায় রপ্তানি জালিয়াতির মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বিদেশে পণ্যচালান হচ্ছে, কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রা প্রত্যাবাসিত হচ্ছে না—এমন গোপন সংবাদের ভিত্তিকে অভিযান চালিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে শনাক্ত করা হয়।
অর্থ পাচারে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো হলো—
প্রজ্ঞা ফ্যাশন লিমিটেড
রাজধানীর সাভারের আশুলিয়ায় অবস্থিত এই প্রতিষ্ঠান ২০১৯ সালে ৩৮৩টি এবং ২০২০ সালে ৮টি সহ ৩৯১টি রপ্তানিচালানের মাধ্যমে অর্থ পাচার করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। রপ্তানিকৃত পণ্যচালানগুলোতে ৩০৮০ মেট্রিক টন টি-শার্ট, প্যান্ট, ট্যাংক-টপ, পাজামা রয়েছে। যা সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে রপ্তানি করেছে। পণ্যচালানগুলোতে রপ্তানিকৃত পণ্যের মূল্য প্রায় ১ কোটি ০৮ লাখ ৪১ হাজার ৬৯৯ মার্কিন ডলার (৯২ কোটি ০৪ লাখ ৬০ হাজার ২৪৫ টাকা প্রায়)। এই প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি জালিয়াতির সাথে জড়িত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট (আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়া খালাসকারী প্রতিষ্ঠান) হলো—চট্টগ্রামের দেওয়ানহাটে অবস্থিত প্রতিষ্ঠান এম এ জে শিপিং কর্পোরেশন, খাতুনগঞ্জের রিয়াংকা ইন্টারন্যাশনাল, আগ্রাবাদের এ অ্যান্ড জে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, সুগন্ধা এলাকার জে জে অ্যাসোসিয়েটস ও বায়েজিদ বোস্তামী এলাকায় অবস্থিত এক্সপ্রেস ফরোয়ার্ডার্স।
ফ্যাশন ট্রেড
রাজধানীর গুলশান এলাকায় অবস্থিত এ প্রতিষ্ঠান ২০২০ সালে ৭৩টি, ২০১৯ সালে ১১৬টি, ২০১৮ সালে ৫৭টি সহ মোট ২৪৬টি রপ্তানিচালানে জালিয়াতি করেছে বলে প্রমাণ পেয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা। রপ্তানিকৃত পণ্যচালানগুলোতে ১৭৭৯ মেট্রিক টন টি-শার্ট, প্যান্ট, ট্যাংক-টপ, পায়জামা প্রভৃতি পণ্য সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ফিলিপাইন, নাইজেরিয়া, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড, সুদান, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে রপ্তানি করা হয়েছে। রপ্তানিকৃত পণ্যের মূল্য প্রায় ৮০ লাখ ৫১ হাজার ৬৪০ মার্কিন ডলার (৬৮ কোটি ৩৫, লাখ ৮৪ হাজার ২৩৬ টাকা প্রায়)। এই প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি জালিয়াতির সাথে জড়িত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টগুলো হলো—এম জে শিপিং কর্পোরেশন, রিয়াংকা ইন্টারন্যাশনাল, এ অ্যান্ড জে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল।
এম.ডি.এস ফ্যাশন
ঢাকার উত্তরায় অবস্থিত এই প্রতিষ্ঠান ২০২০ সালে ১৮২টি রপ্তানিচালানে জালিয়াতি করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। রপ্তানিকৃত পণ্যচালানগুলোতে ১৩৬ মেট্রিক টন টি-শার্ট রয়েছে। তাছাড়া এই প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি সংশ্লিষ্ট দলিলাদি পর্যালোচনা করে দেখা গেছ, অধিকাংশ পণ্যচালান সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, নাইজেরিয়া, কাতার ও ফিলিপাইনে রপ্তানি করা হয়েছে। রপ্তানিকৃত পণ্যের মূল্য প্রায় ৫১ লাখ ৮২ হাজার ৫৮৬ মার্কিন ডলার (৪৪ কোটি ১ হাজার ৫৫১ টাকা প্রায়)। এই প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি জালিয়াতির সাথে জড়িত সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠানগুলো হলো—এ অ্যান্ড জে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, আগ্রাবাদে অবস্থিত জি আর ট্রেডিং কর্পোরেশন, খাতুনগঞ্জে অবস্থিত পান বেঙ্গল এজেন্সি লি.।
হংকং ফ্যাশনস লিমিটেড
রাজধানীর গাজীপুরের টঙ্গী এলাকায় অবস্থিত এই প্রতিষ্ঠান ২০১৮, ২০১৯ এবং ২০২০ সালে মোট ১৫৬টি রপ্তানিচালানে জালিয়াতি করেছে বলে প্রমাণ পেয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর। এই প্রতিষ্ঠানের রপ্তানিকৃত পণ্যচালানগুলোতে ১১৬১ মেট্রিক টন টি-শার্ট রপ্তানি করেছে। প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি সংশ্লিষ্ট দলিলাদি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অধিকাংশ চালান সংযুক্ত আরব আমিরাত, কানাডা, কাতার, নাইজেরিয়া, কুয়েত, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে রপ্তানি করা হয়েছে। রপ্তানিকৃত পণ্যের মূল্য প্রায় ৪৭ লাখ ৮৯ হাজার ৬০৬ মার্কিন (৪০ কোটি ৬৬ লাখ ৩৭ হাজার ৫৮৬ টাকা প্রায়)। এই প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি জালিয়াতির সাথে জড়িত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টগুলো হলো—এম এ জে শিপিং কর্পোরেশন, পান বেঙ্গল এজেন্সি লি., আগ্রাবাদে অবস্থিত পরাগ এসএমএস লি., রিয়াংকা ইন্টারন্যাশনাল ও চট্টগ্রামের সদরঘাটে অবস্থিত মেসার্স এ কে এন্টারপ্রাইজ।
থ্রি-স্টার ট্রেডিং
রাজধানীর বনানীতে অবস্থিত এই প্রতিষ্ঠান ২০২০ সালে ১২০টি রপ্তানিচালানে জালিয়াতি করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। রপ্তানিকৃত পণ্যচালানগুলোতে ৮১৬ মেট্রিক টন টি-শার্ট ছিল। প্রতিষ্ঠানটির সংশ্লিষ্ট দলিলাদি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অধিকাংশ পণ্যচালান মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, কানাডা মিসর প্রভৃতি দেশে রপ্তানি করা হয়েছে। পণ্যচালানগুলোতে রপ্তানিকৃত পণ্যের মূল্য প্রায় ৩০ লাখ ৫৩ হাজার১০৮ মার্কিন ডলার (২৫ কোটি ৯২ লাখ ০৮ হাজার ৮৬৯ টাকা প্রায়)। এই প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি জালিয়াতির সাথে জড়িত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টগুলো হলো— আগ্রাবাদে অবস্থিত জি আর ট্রেডিং কর্পোরেশন, পান বেঙ্গল এজেন্সি, ফকিরহাটের কে আর এস সি অ্যান্ড এফ লি., এ অ্যান্ড জে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল।
ফরচুন ফ্যাশন
রাজধানীর মিরপুরে অবস্থিত এই প্রতিষ্ঠান ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে ৫৯টি রপ্তানিচালানে জালিয়াতি করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। পণ্যচালান অনুযায়ী তারা ৪০০ মেট্রিক টন টি-শার্ট রপ্তানি করেছে। এর মধ্যে অধিকাংশ পণ্যচালান সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, মিশর, কানাডা প্রভৃতি দেশে রপ্তানি করা হয়েছে। রপ্তানিকৃত পণ্যের মূল্য প্রায় ১৫ লাখ ২৪ হাজার ৮১৩ মার্কিন ডলার (১২ কোটি ৯৪ লাখ ৫৬ হাজার ৬২৩ টাকা প্রায়)। এই প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি জালিয়াতির সাথে জড়িত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টগুলো হলো—রিয়াংকা ইন্টারন্যাশনাল, এ অ্যান্ড জে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ও মেসার্স এ কে এন্টারপ্রাইজ।
অনুপম ফ্যাশন ওয়্যার লিমিটেড
ঢাকার কচুক্ষেত এলাকায় অবস্থিত এই প্রতিষ্ঠান ২০২০ সালে ৪২টি রপ্তানিচালানের মাধ্যমে অর্থ পাচার করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। রপ্তানিকৃত পণ্যচালানগুলোতে ১৯৫ মেট্রিক টন টি-শার্ট রপ্তানি করেছে। এর মধ্যে অধিকাংশ পণ্যচালান সংযুক্ত আরব আমিরাত, বেলজিয়াম, নাইজেরিয়া, জর্জিয়া, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে রপ্তানি করা হয়েছে। পণ্যচালানগুলোতে রপ্তানিকৃত পণ্যের মূল্য প্রায় ৮ লাখ ৭৭ হাজার ৪৭০ মার্কিন ডলার (৭ কোটি ৪৪ লাখ ৯৭ হাজার ২০৩ টাকা)। এই প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি জালিয়াতির সাথে জড়িত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টগুলো হলো—পান বেঙ্গল এজেন্সি লি., এ অ্যান্ড জে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, জে জে অ্যাসোসিয়েট, জি আর ট্রেডিং কর্পোরেশন, আগ্রাবাদে অবস্থিত এন এইচ কর্পোরেশন।
পিক্সি নিটওয়্যারস লিমিটেড
গাজীপুরের টঙ্গী এলাকায় অবস্থিত পিক্সি লি. ২০২০ সালে ২০টি রপ্তানিচালানে জালিয়াতি করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। রপ্তানিকৃত পণ্যচালানগুলোতে ১৭০ মেট্রিক টন টি-শার্ট রপ্তানি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। তাদের দলিলাদি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অধিকাংশ পণ্যচালান সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কাতার, কুয়েত, ফিলিপাইনস, নাইজেরিয়া, শ্রীলংকা প্রভৃতি দেশে রপ্তানি করা হয়েছে। রপ্তানিকৃত পণ্যের মূল্য প্রায় ৫ লাখ ৯৬ হাজার ২৮২ মার্কিন ডলার (৫ কোটি ০৬ লাখ ২৪ হাজার ৩৪১ টাকা প্রায়)। এই প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি জালিয়াতির সাথে জড়িত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টগুলো হরো—জি আর ট্রেডিং কর্পোরেশন ও এন এইচ কর্পোরেশন।
স্টাইলাইজ বিডি লিমিটেড
ঢাকার শাহবাগের এই প্রতিষ্ঠান ২০২০ সালে ১০টি রপ্তানিচালানে জালিয়াতি করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। রপ্তানিকৃত পণ্যচালানগুলোতে ৬৬৮ মেট্রিক টন টি-শার্ট রপ্তানি করেছে তারা। এর মধ্যে অধিকাংশ পণ্যচালান ফ্রান্স, কানাডা, রাশিয়া, স্লোভেনিয়া, পানামা প্রভৃতি দেশে রপ্তানি করা হয়েছে। আলোচা পণ্যচালানগুলোতে রপ্তানিকৃত পণ্যের মূল্য প্রায় ২ লাখ ৫৫ হাজার ৬২৯ মার্কিন ডলার (২ কোটি ১৭ লাখ ২ হাজার ৯০২ টাকা প্রায়)। এই প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি জালিয়াতির সাথে জড়িত সিএন্ডএফ এজেন্টগুলো হলো—জি আর ট্রেডিং কর্পোরেশন, পান বেঙ্গল এজেন্সি লি. এবং কে আর এস সিঅ্যান্ডএফ লি.।
ইডেন স্টাইল টেক্স
ঢাকার খিলক্ষেত এলাকার এই প্রতিষ্ঠান ২০২০ সালে ৮টি রপ্তানিচালানে জালিয়াতি করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। রপ্তানিকৃত পণ্যচালানগুলোতে ৪২ মে. টন টি-শার্ট রপ্তানি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। যার মধ্যে অধিকাংশ পণ্যচালানগুলো টোঙ্গা, ওমান, ব্রুনাই, মালয়েশিয়া, শ্রীলংকা প্রভৃতি দেশে রপ্তানি করা হয়েছে। রপ্তানিকৃত পণ্যের মূল্য প্রায় ১ লাখ ৯৪ হাজার ৮৫ মার্কিন ডলার (১ কোটি ৬৪ লাখ ৭৭ হাজার ৮১৬ টাকা প্রায়)। এই প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি জালিয়াতির সাথে জড়িত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টগুলো হলো—জি আর ট্রেডিং কর্পোরেশন, পান বেঙ্গল এজেন্সি লি. ও কে আর এস সিএন্ডএফ লি.।
মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।