লম্বা ছুটি—বৃহত্তর চট্টগ্রামের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে উপচে পড়া ভিড়

ভ্রমণ যেমন মানুষের মানসিক প্রশান্তি দেয় তেমনি দূর করে অবসাদ। তাইতো সুযোগ পেলেই ভ্রমণপিপাসুরা ছুটে যান পাহাড়,নদী,ঝরণা কিংবা সাগরের কাছে। তার ব্যতিক্রম হয়নি এবারও। মুসলমানদের পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দুর্গাপূজা এবং সাপ্তাহিক ছুটি—সব মিলিয়ে টানা পাঁচ দিনের ছুটিতে বৃহত্তর চট্টগ্রামের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে বেড়েছে দর্শনার্থীদের আনাগোনা। তার উপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লম্বা বন্ধ ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য তৈরি করেছে সুযোগ।
বৃহস্পতিবারও (৬ অক্টোবর) বৃহত্তর চট্টগ্রামের কক্সবাজার, রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়িতে দেখা গেছে পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড়। দর্শনীয় স্থান, বিনোদন কেন্দ্রগুলো মুখরিত ছিলো দর্শনার্থীদের পদচারণায়।

কক্সবাজারে ‘জলখেলায়’ মেতেছে কর্মব্যস্ত মানুষ:
পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। যেখানকার সমুদ্র জলের অপরূপ সৌন্দর্য প্রতিনিয়ত আকৃষ্ট করে প্রকৃতিপ্রেমীদের। তার সাথে সূর্যাস্তের দৃশ্য ও চারপাশের পর্যটনকেন্দ্রগুলোর জন্য দেশ-বিদেশের সকলের কাছে আগ্রহের জায়গা কক্সবাজার। দীর্ঘদিন পর্যটকশূণ্য কক্সবাজারে ফিরেছে প্রাণ। পর্যটকের পদভারে আবারও মুখরিত হয়ে উঠেছে সৈকত। শুধু সৈকত নয়, আশপাশের বিনোদন কেন্দ্রগুলোতেও উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে।

সরজমিনে দেখা গেছে, শহরের হোটেল-মোটেল কোথাও জায়গা খালি নেই। একের পর এক পর্যটক আসছে। গতকাল বুধবার বিকেল থেকে বেড়েছে পর্যটক। বৃহস্পতিবার আগের দিনের চেয়ে আরও বেড়েছে এর সংখ্যা। সৈকতজুড়ে যেন বসেছে লোকের মেলা। সমুদ্রে গা ভিজিয়ে সমুদ্রবিলাসে মেতেছে পর্যটকরা।

হোটেল সি-প্রিন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল বাশার সুমন বলেন, এবারে পর্যটন মৌসুমের শুরুতে প্রচারণার ফলে কক্সবাজারের হোটেল-মোটেলে এখন থেকে সুফল পেতে শুরু করেছে। আমাদের আগামী ১০ অক্টোবর পর্যন্ত কক্সবাজারের ৪২৫টি হোটেল মোটেলের ৯০ ভাগ বুকিং হয়েছে। আর ২৫০টির মত রেস্টুরেন্টেও বেড়ছে বেচাবিক্রি।

রাঙামাটির ‘ঝর্ণা-লেকে’ সবুজপ্রেমীদের উচ্ছ্বাস:
পর্যটকরা শুধু যে সমুদ্রস্নানে মেতেছেন তা নয়। রাঙামাটির পাহাড়ি ঝর্ণা ও কাপ্তাই লেকেও বসেছে মানবের হাট। পার্বত্য জেলা রাঙামাটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এখানে ছুটে এসেছেন ভ্রমণপিপাসুরা। বৃহস্পতিবার জেলা শহরের মূল পর্যটনকেন্দ্র ও বিনোদনকেন্দ্রসহ পুরো রাঙামাটি শহরজুড়ে পর্যটকদের সরব উপস্থিতি দেখা গেছে।

জানা গেছে, বিপুল পর্যটকের আগমনে হোটেল মোটেল ছাড়াও শহরের পর্যটন সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যবসাও জমজমাট। এতে চাঙ্গা হয়ে উঠেছে পরিবহন, হোটেল, রেস্তোরাঁ, পোশাক ও স্থানীয় উৎপাদিত পণ্য-সামগ্রী বিপণীসহ পর্যটন সংশিষ্ট ব্যবসা-বাণিজ্য। এর ফলে ব্যস্ত সময় পার করছেন রাঙামাটি শহরের অভ্যন্তরীণ একমাত্র যানবাহন অটোরিকশা ও নৌযান চালকেরাও। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে আগত পর্যটকরা রাঙামাটির ঝুলন্ত সেতুসহ বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্রে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। রাঙামাটিতে পর্যটনের আকর্ষণীয় স্পটের মধ্যে শুভলং ঝর্ণা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জাদুঘর, ডিসি বাংলো পলওয়েল পার্ক, কাপ্তাই লেক, পেদাটিংটিং, টুকটুক ইকো ভিলেজসহ কাপ্তাই লেকের পাড়ে গড়ে ওঠা বিভিন্ন পর্যটন স্পটগুলো পর্যটকদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে।

রাঙ্গামাটি হোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মঈন উদ্দিন সেলিম বলেন, টানা ছুটিতে এখানে প্রচুর পর্যটক এসেছেন। এছাড়াও ছুটির দিনেও পর্যটকের ভিড় লেগেই থাকে। শীত মৌসুমের শেষ দিকে ভালো সাড়া পাচ্ছি আমরা। আগে থেকেই বুকিং হয়ে থাকায় প্রতিটি হোটেল-মোটেল পরিপূর্ণ পর্যটকে।

টানা ছুটিতে পর্যটকে মুখরিত বান্দরবান:
পাহাড়ের প্রাকৃতিক দৃশ্য আর বিচিত্রময় জীবন ধারা দেখতে এই ছুটিতে পর্যটকে মুখরিত হয়ে পড়েছে বান্দরবান। পরিবার পরিজন নিয়ে পার্বত্য বান্দরবানের অপার সৌন্দর্য দেখতে হোটেল মোটেল ও রিসোর্টগুলো আগে থেকে বুকিং দিয়ে রেখেছেন। বান্দরবানে পাহাড়-পর্বত ছাড়াও এখানে রয়েছে অসংখ্য ঝিরি-ঝর্ণা, মেঘলার লেক, স্বর্ণমন্দির, নীলাচল, নীলগিরি, শৈলপ্রপাত, নাফাকুম, রেমাক্রি, চিম্বুক, নীলদিগন্তসহ সরকারি-বেসরকারি অনেকগুলো পর্যটন স্পট। ছুটিতে ভ্রমণপিপাসু পর্যটকের পদভারে এখন মুখর হয়ে উঠেছে বান্দরবান। পুরো শহরজুড়ে পরিণত হয়েছে মিলনমেলায়।

বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বান্দরবানের বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, পর্যটকদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে। মেঘলা, নীলাচল, নীলগিরিসহ সবখানে ছুটে বেড়াচ্ছে পর্যটকরা। পরিবার-পরিজন বন্ধু-বান্ধব নিয়ে অবকাশ যাপনে ব্যস্ত সময় পার করছে ভ্রমণপিপাসুরা। চাঁদের গাড়িতে করে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে ছুটছেন পাহাড়ের সৌন্দর্য্য দেখতে। হোটেল-মোটেল গেস্ট হাউজগুলোও এখন জমজমাট পর্যটকদের পদচারণায়। দীর্ঘ দিন পর পর্যটকদের আগমন বেড়ে যাওয়ায় খুশি পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।

জেলার হোটেল মোটেল রিসোর্ট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম বলেন, পূজার বন্ধতে হোটেল মোটেল রিসোর্ট গুলো এখন প্রায় অর্ধেক পরিপূর্ণ। হয়তো আরো পর্যটক আসবে। সে অনুযায়ী সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

স্বপ্ন বিলাস রিসোর্টের পরিচালক বিশ্বজিৎ দাশ বাপ্পা বলেন, পূজার ছুটিতে বান্দরবানে প্রচুর পর্যটকের সমাগম ঘটেছে। আমাদের হোটেলের সবগুলো রুম বুকিং হয়েছে। অনেকে রুমের জন্য আসছে তাদেরকে রুম দিতে পারছি না। পর্যটকরা বেশি ঘুরতে যাচ্ছেন থানচি, রুমা আর রোয়াংছড়ির দেবতা খুমে। থানচির তমাতুঙ্গি, বাকলাই, বড় পাথর সহ বিভিন্ন ঝর্ণা দেখতে পর্যটকরা ছুটে যাচ্ছেন। এছাড়া নীলাচল, নীলগির, শৈলপ্রপাত, প্রান্তিক লেক সহ বিভিন্ন জায়গায় পর্যটকদের সমাগম বেড়েছে।

লাখো পর্যটকের সমাগম খাগড়াছড়িতে:
চট্টগ্রামের অন্যসব স্থানের মতো পর্যটকরা ভিড় জমিয়েছেন খাগড়াছড়ির পর্যটনকেন্দ্রগুলোতেও। সদর উপজেলার হর্টিকালচার হ্যারিটেজ পার্ক, আলুটিলার প্রাকৃতিক গুহা, শতবর্ষী য়ংড বৌদ্ধ বিহার, আলুটিলা বৌদ্ধ বিহার, কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, দশবল বৌদ্ধ বিহার, চেঙ্গি নদীর তীরবর্তী বিভিন্ন স্থাপনা, মাটিরাঙার শতবর্ষী বটগাছ, উপজেলা প্রশাসন লেক, জলপাহাড়, ভগবান টিলা, রিছাং ঝরনা, মহালছড়ির মনারটেক লেক, দেবতার পুকুর, মানিকছড়ির বনলতা অ্যাগ্রো প্রাইভেট, পুরাতন রাজবাড়ি, পানছড়ির অরণ্য কুঠির, মায়াবিনী লেক, রাবার ড্যাম, রামগড়ের কৃত্রিম লেক, চা-বাগান, কলসি মুখ, প্রতিষ্ঠাকালীন বিজিবির ভাস্কর্য, দিঘিনালার হাজাছড়া-তৈদুছড়া ঝরনাসহ শতাধিক পর্যটন স্পট রয়েছে। এসব পর্যটন স্পটে বুধবার থেকে প্রচুর পর্যটক এসেছেন। সব হোটেল-মোটেলে উঠেছেন পর্যটকরা। বৃহস্পতিবার বেড়েছে পর্যটকের সংখ্যা।

হোটেল-মোটেল মালিকরা জানিয়েছেন, ৮ অক্টোবর পর্যন্ত জেলার এবং সাজেকের সব হোটেল-মোটেল ও কটেজ বুকিং হয়ে গেছে। জেলায় সবমিলিয়ে ১২০ এবং সাজেকে ১১০টি হোটেল-মোটেল ও রিসোর্ট রয়েছে। এসব হোটেল-মোটেলে ৬০-৭০ হাজার পর্যটকের থাকার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু পর্যটক এসেছেন লক্ষাধিক। হোটেল-মোটেলে জায়গা না পেয়ে অনেক পর্যটক আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে থাকছেন।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।