‘গ্রীষ্মের শাটল যেন হাইফ্লেমে থাকা কুকার’
একজনের পায়ের সাথে লেগে আছে অন্যজনের পা, পিঠের সাথে পিঠ। দুই জনের সিটে ৩ জন, বাতাস প্রবেশের জানালা ঘেঁষেও আরও একজন। পাদানিতে বসে আছেন দুজন, দরজায়ও ঝুলে আছেন আরও কয়েকজন। একে তো তপ্ত রোদ তার ওপর বাড়তি যাত্রীর জটলা। সব মিলিয়ে এক নাজেহাল পরিস্থিতি বিরাজ করছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) গৌরবের শাটল ট্রেনে।
জানা গেছে,দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে অনলাইন ক্লাসের সিদ্ধান্তে গেলেও কিছুদিন পর তা থেকে সরে আসে। একইভাবে চবিও সশরীরে ক্লাস কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসের বাইরে কিংবা শহরে অবস্থান করেন। শহর থেকে ক্যাম্পাসে যাতায়াত করতে নিয়মিতই পাড়ি দিতে হয় দীর্ঘ ১ ঘন্টার। আর এই পথে শিক্ষার্থীদের অন্যতম বাহন হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব শাটল ট্রেন।
শিক্ষার্থীদের এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার প্রধান বাহন এক জোড়া শাটল ট্রেন৷ ক্লাস, পরীক্ষা টিউশনসহ নানা প্রয়োজনে শাটল ট্রেনে চড়ে প্রতিদিন অন্তত ১০ হাজার শিক্ষার্থী শহর থেকে ক্যাম্পাসে যাওয়া আসা করেন। তবে পর্যাপ্ত বগি আর শিডিউলে অভাবে শাটল ট্রেনে চরম গাদাগাদি করে আসতে হয় তাদের। বিশেষ করে শহর থেকে ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা সকাল সাড়ে ৭টা, ৮টা, পৌনে ১০টার ট্রেন আর ক্যাম্পাস থেকে শহরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে দুপুর দেড়টা, আড়াইটা ও বিকেল ৪টা’র শাটলে শিক্ষার্থীদের ভিড় ও গাদাগাদিতে বগিগুলোর ভেতরে তিল ধারণের জায়গাও থাকে না।
সরজমিনে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছেড়ে যাওয়া এবং শহর থেকে ছেড়ে আসা বেশ কয়েকটি ট্রেনে গিয়ে দেখা গেছে ভয়াবহ চিত্র। শিক্ষার্থীরা অত্যন্ত গাদাগাদি করে শাটল ট্রেনে যাতায়াত করছেন। কেউ কেউ বসার সীট পেলেও অধিকাংশ শিক্ষার্থীকে পুরো পথ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এ সময় শিক্ষার্থীদের ভিড় এতোটাই হয় যে শিক্ষার্থীদের নাড়াচাড়া করাটাই দায় হয়ে যায়। অপরদিকে অত্যাধিক ভিড়ের কারণে বাইরের বাতাসও শাটলের ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে না। এছাড়া প্রতিটি বগির সিলিংয়ে বৈদ্যুতিক ফ্যান থাকলেও তা চালানো হয় না কখনও। যার কারণে প্রচন্ড ভিড় আর তীব্র গরমে প্রাণ যায় য়ায় অবস্থা শিক্ষার্থীদের।
এদিকে ২০২১ সালের ১১ নভেম্বর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় রুটে চলাচল করা ডেমু ট্রেনটিও বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। ট্রেনটি প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে মোট দুইবার যাওয়া আসা করত। বন্ধ হওয়ার দীর্ঘ ২৯ মাস পেরিয়ে গেলেও সেই ডেমু ট্রেনটি আজ পর্যন্ত চালু হয়নি। এই শিডিউলে অন্য কোনো ট্রেন চলাচলের ব্যবস্থাও করেনি কর্তৃপক্ষ। এছাড়া ২০১৯ সালে ২৪ জুলাই চবিতে এসে তৎকালীন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন নতুন ট্রেনের ঘোষণা দিলেও তা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। ট্রেনের জন্য রেল লাইন এবং ফ্ল্যাটফর্মের নানা সংস্কার কাজ হলেও শাটলের যেন গন্তব্য বদলে গেছে!
শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিভিন্ন সময় শাটল ট্রেনের বগি শিডিউল বৃদ্ধি, ও ফ্যান চালানোর ব্যবস্থা করা আবেদন জানালেও কর্তৃপক্ষ তাতে কোনো প্রকার কর্ণপাত করেননি। নানান জন এসে, নানান কথা বলে যান —তারা চলে গেলে আরেক দল আসেন, আবার একই কথা শুনিয়ে যান। এই করেই চলছে সময়, দুর্ভোগ যেন শিক্ষার্থীদের চিরসাথী।
তারা আরও বলেন, কিছুদিন পর প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হলে শিক্ষার্থীদের ভিড় আরও বৃদ্ধি পাবে। এমতাবস্থায় তীব্র গরমে শাটল ট্রেনের ভেতরে যেকোনো সময় হিট স্ট্রোকের ঘটনা ঘটতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন শিক্ষার্থীরা। পাশাপাশি গরমের তীব্রতা থেকে বাঁচতে ও শাটল ট্রেনের ভিড় কমাতে অন্তত শাটল ট্রেনের শিডিউল বৃদ্ধি ও ফ্যানগুলো চালানোর ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তীব্র সমালোচনা
শিক্ষার্থীদের এমন নাজেহাল অবস্থার কথা উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানাভাবে তাদের ক্ষোভ ঝাড়ছেন। সমালোচনায় টেনে আনছেন শিক্ষকদের ‘আয়েশি’ যাত্রার কথাও।
মোহাম্মদ মাসুদ নামে এক শিক্ষার্থী নিজ ফেইসবুক পোস্টে লিখেছেন, “সাড়ে ৭টা ও ৮টার শাটল, দেড়টা, আড়াইটা ও ৪টার শাটলে এক সপ্তাহ যাতায়াতের পর প্রশাসন যদি মনে করেন এটা শিক্ষার্থীদের যাতায়াত উপযোগী, আমি তওবা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব বাতিল করে চলে যাবো।”
তন্ময় দত্ত নামে আরেক শিক্ষার্থী লিখেছেন, “সুকান্ত ভট্টাচার্য এখন বেঁচে থাকলে হয়ত লিখতেন—‘গ্রীষ্মের শাটল যেন হাইফ্লেমে থাকা কুকার!’ স্টুডেন্ট’রা এক একটা চালের দানা! সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফুটছে আর দেখছে পাশেই এসি বাসে করে ঘুমুতে ঘুমুতে শ্রদ্ধেয় গুরু’রা যাচ্ছে!”
এসব বিষয় নজরে আনলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. অহিদুল আলম বলেন, শাটল ট্রেনে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির বিষয়ে আমরা অবগত আছি। আমরা সরেজমিনে পর্যবেক্ষণও করেছি। এসব বিষয়ে রেলওয়ের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। আগামীকাল আমরা রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের সাথে বসব। সেখানে শাটল ট্রেনের শিডিউল বৃদ্ধি ও ফ্যান চালানোর বিষয়ে প্রস্তাব জানাব। আমরা শীঘ্রই এ সমস্যা সমাধানের দৃশ্যমান ব্যবস্থা নিতে পারব বলে আশাবাদী।
জানতে চাইলে চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবু তাহের বলেন, রেলওয়ের সাথে আমাদের কথা হয়েছে। ফ্যান চালানোর জন্য পাওয়ার কার যুক্ত করতে হবে ট্রেনে। আমরা সেটার আবেদন রেলওয়েকে জানিয়েছি। বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে।
আরও পড়ুন
চবি খুললেও চালু হয়নি ৩ জোড়া শাটল
চবি শিক্ষার্থীদের শাটলে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ প্রশাসন!
মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।