সমতলেও চাঁদাবাজি, অপহরণে বেপরোয়া ‘পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা’
বাঁশখালীর রশিদ, দিন মজুরের কাজ করতেন পটিয়ায় একটা পাহাড়ে লেবু বাগানে। তার সঙ্গে কাজ করতো কিছু চাকমা উপজাতি। গত বছর মে মাসের মাঝামাঝি একদিন বিকেল থেকে রশিদের মোবাইলে ফোন করে পাচ্ছিলো না তার স্ত্রী-স্বজনরা। গভীর রাতে অচেনা নাম্বার থেকে আসা ফোন কলে ঘুম ভাঙ্গলো রশিদের স্ত্রীর। ১০ লাখ টাকা না পেলে রশিদকে তারা খুন করে পাহাড়ে মাটি চাপা দিবে।
পরদিন রশিদের স্ত্রী আত্মীয় স্বজনের দারস্থ হলেন। রশিদের ভাই, ভগ্নিপতিসহ আত্মীয় স্বজন মিলে তিন লাখ টাকা জোগাড় করলেন। বান্দরবানে গিয়ে অজ্ঞাত সন্ত্রাসীদের হাত পৌঁছে দিলেন তিন লাখ টাকা। রাতের বেলায় চট্টগ্রাম—কক্সবাজার মহাসড়কের চন্দনাইশ—পটিয়ার মাঝামাঝি রশিদকে নামিয়ে দিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা।
রশিদের ভগ্নিপতি জাকির হোসেন চট্টগ্রাম খবরকে বলেন, রশিদই প্রথম নয়। পটিয়া, চন্দনাইশে অপহরণ, মুক্তিপন নিয়মিত ঘটনা। আমরা টাকা দিতে না পারলে রশিদকে ফিরে পেতাম না।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন কিনা জানতে চাইলে জাকির বলেন—থানা পুলিশে জানালে রশিদকে জীবিত পাওয়া নিয়ে শঙ্কা ছিল। তাই আমরা সেদিকে যাইনি।
গত ৮ জুলাই রাতে চন্দনাইশ থেকে দেশিয় বন্দুকসহ পাহাড়ি তিন সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো—রোয়াংছড়ির মৃত সত্যবান ত্রিপুরার ছেলে কিলিরাম ত্রিপুরা (৩৬), আলীকদমের শিগরাং ত্রিপুরার ছেলে যেহেল ত্রিপুরা (৩৪) এবং পশ্চিম ধোপাছড়ির নন্দমনি ত্রিপুরার ছেলে সুভাষ ত্রিপুরা (২২)।
এ বিষয়ে চন্দনাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, পাহাড়ি সন্ত্রাসীগোষ্ঠী অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ করে গা ঢাকা দিতো৷ তাদের ধরতে পুলিশের নজরদারি অব্যাহত ছিলো। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা দায়ের হয়েছে।
একই ঘটনায় দোহাজারী পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডের হাতিয়া খোলা ঘিলাতলী অলি ফকিরের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের স্থানীয় সোর্স মো. আনোয়ারকে (২৬) গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। আনোয়ার স্থানীয় অলি আহম্মদ প্রকাশ অলি ফকিরের ছেলে। সস্ত্রাসীদের সোর্স আনোয়ারের কাছ থেকে একটি দেশীয় তৈরী একনালা বন্দুক, একটি কার্তুজ, ৩টি বন্দুকের বাট বিহীন নল, ৩টি ছাপাতি, ৫টি ছোট ও বড় ছুরি এবং একটি ধামা উদ্ধার করেছে পুলিশ।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান—পাহাড় থেকে পাহাড়ী পথে এসে পটিয়া, চন্দনাইশ এলাকায় কৃষকদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে মুক্তিপন আদায় করে এই সন্ত্রাসীরা। চাহিদা মতো টাকা না পেয়ে একাধিক কৃষককে হত্যা ও গুম করার ঘটনাও ঘটেছে।
তেমনি একটি হত্যা মামলা আদালতের আদেশে তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন—পিবিআই চট্টগ্রাম জেলা। ওই মামলা সম্পর্কে জানতে চাইলে পিবিআই চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার নাজমুল হাসান বলেন, আমাদের তদন্ত চলমান। কৃষক অপহরণের ঘটনায় আমরা এক উপজাতিকে গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করেছিলাম। আদালতের অনুমতি নিয়ে সেই আসমিকে সঙ্গে নিয়ে কৃষকের মরদেহ উদ্ধারে গিয়েছিলাম। কিন্তু তার দেখানো স্থানে প্রবাহমান পানির ছড়া ছিল। শুষ্ক মৌসুমে কৃষককে অপহরণের পর মুক্তিপন না পেয়ে হত্যা করে মাটি চাপা দিয়েছে বলে আমাদের কাছে স্বীকার করেছে। কিন্তু কোথায় মাটি চাপা দিয়েছে সেটি এখনো নির্ণয় করা যায়নি।
সেই হতভাগা কৃষক পরিবার মুক্তিপন দিতে পারেনি বলে তাকে হত্যা করে মাটি চাপা দেয়া হয়েছে। আর রাউজানের কলেজ শিক্ষার্থী শিবলী সাদিক হৃদয়ের পরিবার মুক্তিপনের টাকা পৌঁছে দেওয়ার পরও তাকে টুকরো টুকরো করে হত্যা করেছে পাহাড়ী সন্ত্রাসীরা। হৃদয়ের পরিবারের কাছে সন্ত্রাসীরা ১৫ লক্ষ টাকা মুক্তিপন দাবি করেছিল। পরিবার দুই লক্ষ টাকা অপহরণকারীদের হাতে পৌঁছে দিয়েছিল। হৃদয়ের সঙ্গে একই মুরগী খামারে চাকরি করা তার সহকর্মী ছিল খুনিরা। সহকর্মীরাই তাকে খুন করেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
অপরদিকে রোববার (১০ সেপ্টেম্বর) খাগড়াছড়িতে খাগড়াছড়ির রামগড়ে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় অপহরণের শিকার হন দুটি কাভার্ড ভ্যান চালক ও তাদের দুই সহযোগী। সেনাবাহিনীর অভিযানের মুখে সন্ত্রাসীরা সেই চারজনকে সোমবার রাতে ছেড়ে দেয়।
বান্দরবানের রুমা উপজেলা-বগালেক-কেওক্রাডং সড়ক নির্মাণে কাজ করছিল সেনাবাহিনীর ২৬ ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটালিয়নের অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট মো. আনোয়ার হোসেনসহ ২ শ্রমিক। কাজ চলাকালীন সময় ১৬ মার্চ বিকালে হঠাৎ সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্যরা এসে তাদেরকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরে সেনা অভিযানের মুখে তাদের ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যায় অপহরণকারীরা।
গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে রাঙামাটির কাউখালী থেকে মোসলেম উদ্দিন (৪২), আহসান উল্ল্যাহ (৪৫) ও মো. জিয়াউর রহমান জিকু (২৮) নামের তিন শ্রমিককে অপহরণ করে পাহাড়ী সন্ত্রাসীরা। এক সপ্তাহ টানা কাজ করে পুলিশ তাদের উদ্ধার করে এবং খাগড়াছড়ি বিনাজুরি পাড়া গ্রামের আদ্যায়ং মারমার ছেলে ক্যামং মারমা (২২) এবং বান্দরবান রোয়াজাপাড়া গ্রামের মংলু মারমার ছেলে উক্যাওয়াই মারমাকে (২০) গ্রেপ্তার করে।
গত ১৫ জুন ৫/৬ জনের একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী খুঁটি থেকে বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে রাঙামাটির রাজস্থলীর লংগদু পাড়া এলাকায় প্রবেশ করে অস্ত্রের মুখে তিনজনকে তুলে নিয়ে অজ্ঞাত স্থানে চলে যায়। পরে সেনাবাহিনী ও পুলিশ যৌথ অভিযান চালিয়ে তাদের উদ্ধার করে। এপ্রিল, মে, জুন মাসে রাজস্থলী থেকেই ১৪ শ্রমিক অপহরণ করে মুক্তিপন আদায়ের ঘটনা ঘটেছে বলে জানায় বিভিন্ন উন্নয়ন কাজে সম্পৃক্তরা।
গত বছর ১৫ এপ্রিল রাঙ্গুনিয়া উপজেলার সরফভাটা ইউনিয়নের মিরেরখীল বড়খোলা পাহাড়ে কাজ করতে গিয়ে পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের হাতে অপহরণের শিকার হয়েছেন তিন ব্যক্তি। ওইদিন সন্ধ্যার দিকে পুলিশ তাদের উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। অপহৃতদের দুইজন সরফভাটা ইউনিয়নের হাজির খিল মাওলানা গ্রামের মৃত সামছুল আলমের ছেলে এজলাস মিয়া (৬০), হায়দুরকুল গ্রামের মৃত মো. সোবাহানের ছেলে মো. বাচা (৪৫)। অপরজন কক্সবাজার জেলার কৃষিশ্রমিক মো. জাফর (২২)।
তিন পার্বত্য জেলার পাশাপাশি চট্টগ্রামের পাহাড়ী উপজেলাগুলোতে অপহরণ, মুক্তিপনের জাল পেতেছে পাহাড়ী সন্ত্রাসীরা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভিকটিম পরিবার মুক্তিপন দিয়ে সমঝোতা করে, যেমনটি করেছে রাউজানের হৃদয়ের পরিবার কিংবা বাঁশখালীর রশিদের পরিবার। রশিদের পরিবারের ভাগ্য ভালো হলেও লাশ হলো হৃদয়। হৃদয়কে অক্ষত উদ্ধার করতে না পারায় তার খুনিদের একজনকে পুলিশ হেফাজত থেকে কেড়ে নিয়ে স্থানীয় জনগণ পিটুনি দিয়ে হত্যা করে তাদের ক্ষোভ মেটায়।
হৃদয়ের সঙ্গে একই খামারে চাকরি করতো তার খুনিরা। তেমনি চট্টগ্রামের বিভিন্ন পশু খাবার, মুরগী খামার, কৃষি খামারে বাঙ্গালীদের সঙ্গে চাকরি করে উপজাতি শ্রমিক। অনেকের ধারণা এসব শ্রমিকদের একটা অংশ পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের সোর্স হিসেবে কাজ করে। এমন বিষয় টের পেয়ে রাউজানের এক খামারি তার খামার থেকে উপজাতি শ্রমিকদের বিদায় করে দেয়ার কথা জানান মমতাজ নামের এক খামারি।
এধরণের অপরাধ প্রবণ এলাকায় অস্থায়ী শ্রমিকদের নজরধারিতে রাখার বিষয়টি এতদিন পুলিশের ছিল না। সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। সামনে তাদের ওপর নজরধারি বাড়ানো ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানিয়েছে জেলা পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা।
মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।