হারিয়ে যাচ্ছে রাজবংশী ভাষা ও সংস্কৃতি

বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী একটি জাতিগোষ্ঠী হলো ‘রাজবংশী’। নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতিতে তারা ছিল সমৃদ্ধ। কিন্তু কালের বিবর্তনে তাদের সে ইতিহাস ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে। হারিয়ে যেতে বসা এই রাজবংশী ভাষা ও সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে কাজ করে যাচ্ছে ‘রাজবংশী ভাষা ও সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্র’।

রাজবংশী ভাষার জনপ্রিয় একটি কথা ‘ভাষা বত্তিলে জাতি বত্তে।’ যার অর্থ ‘ভাষা বাঁচলে জীবন বাঁচে।’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে চট্টগ্রাম গবেষণা উৎসবে স্টল সাজিয়েছেন বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মাখন চন্দ্র রায়। উত্তরবঙ্গের বহুল প্রচলিত আঞ্চলিক এ ভাষা ও সাধারণ জনগণের জীবন যাত্রার নানা দিক উঠে এসেছে এতে।

সোমবার (২৭ ফেব্রুয়ারী) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শহীদ মিনার চত্বরে আয়োজিত ‘চট্টগ্রাম রিচার্স ফেস্টিভ্যাল-২০২৩’ শীর্ষক গবেষণা মেলায় এ স্টল সাজিয়েছেন ড. মাখন চন্দ্র রায়।

স্টল ঘুরে দেখা যায়, উত্তরবঙ্গের রাজবংশী জনগোষ্ঠীর ভাষা, সংস্কৃতি ও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার নানা দিক তুলে ধরেছেন ড. মাখন। যেখানে স্থান পেয়েছে রাজবংশী ভাষার নির্মিতি ও শব্দবৈভব, রাজবংশী জনগোষ্ঠির সমাজ সংস্কৃতি, লোকপ্রযুক্তি, উত্তরবঙ্গের লোকসাহিত্য।
আরো ছিল উত্তরবঙ্গের জনমানুষের ব্যবহার্য নানা জিনিসপত্র। যার মধ্যে রয়েছে টোপা যেটি গরুর মুখে লাগানো হয় যাতে করে গরু অন্যের ক্ষেতের ফসলে মুখ দিতে না পারে। রয়েছে ঝাপি (রোদ থেকে বাঁচতে কৃষকরা মাথায় ব্যবহার করেন), চাইলন (ধান, চাউল, গম ইত্যাদি ঝাড়তে ব্যবহার্য), ডুলি (ঝুড়ি বিশেষ), ডালা (বিয়ের গহনা ও অন্যান্য ছোট সরঞ্জাম বহনে ব্যবহার্য), ডারকি (মাছ ধরার যন্ত্র) ও বিচন (হাতপাখা) ইত্যাদি।

স্টলে ‘ভাষা বত্তিলে জাতি বত্তে’ শিরোনামে একটি মন্তব্য বই রাখা হয় যেখানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত দর্শনার্থীরা নিজ নিজ আঞ্চলিক ভাষায় তাদের ভাষা বিষয়ক একটি করে ভাবনা লিপিবদ্ধ করেন। এছাড়াও রাজবংশী ভাষায় লিখিত বিভিন্ন ও রাজবংশী ভাষা বিষয়ক বিভিন্ন গবেষণামূলক পত্র পত্রিকা ও পুস্তক প্রদর্শন করা হয়।

এছাড়াও উত্তরবঙ্গের রাজবংশী জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী খাবার সম্পর্কেও ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে উক্ত স্টলে। যার মধ্যে রয়েছে সিদল, ছাকা, প্যালকা ইত্যাদি।

এ বিষয়ে ড. মাখন চন্দ্র রায় বলেন, বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের সুপ্রাচীনকাল থেকে বসবাসকারী জাতিগোষ্ঠী রাজবংশী। তাদের স্বতন্ত্র ও সমৃদ্ধ ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে৷ তবে কালের বাস্তবতায় এই ভাষা বিপন্ন অবস্থায়। রাজবংশী ভাষা ও সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্র মূলত এই ভাষা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও পরিচর্যার প্র‍য়াস করছে।

রাজবংশীরা হল দেশের উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর সহ অন্যান্য এলাকায় বসবাসরত একটি জাতিগোষ্ঠী যারা মূলত ছিলেন কোচ ও পালিয়া আদিবাসীগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। পরবর্তীতে সময়ের বিবর্তনে তাঁরা বাঙালী জনগোষ্ঠীর সাথে মিশে যায়। যার ফলে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি উত্তরবঙ্গের সাধারণ জনগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে একাকার হয়ে যায়। বর্তমান সময়ে এসে মূল রাজবংশী ভাষা ও সংস্কৃতি বিপুপ্তির পথে।

প্রসঙ্গত, সোমবার (২৭ ফেব্রুয়ারী) সকাল সাড়ে নয়টায় জামাল নজরুল ইসলাম গণিত ও ভৌত বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র এবং চিটাগাং ইউনিভার্সিটি রিসার্চ এন্ড হায়ার স্টাডি সোসাইটি (সিইউআরএইচএস) এর যৌথ উদ্যোগে গবেষণা মেলা শুরু হয়।

প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে এ মেলার উদ্বোধন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার। এসময় স্বাগত বক্তব্য রাখেন ‘সিউআরএইচএস’র মডারেটর অধ্যাপক ড. আদনান মান্নান, শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক ড. অলক পাল।

এছাড়াও, বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন উপ-উপাচার্য অধ্যাপক বেনু কুমার দে, বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. নাসিম হাসান, গবেষক ড. আব্দুল মনসুর চৌধুরী, ড. জামাল নজরুল ইসলামের কন্যা সাদাফ সিদ্দিকী, সভাপতিত্ব করেন জামাল নজরুল ইসলাম গণিত ও ভৌত বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দের ডিরেক্টর ও রিসার্চ ফেস্টিভ্যাল-২০২৩ এর আহবায়ক অধ্যাপক অঞ্জন কুমার চৌধুরী।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।