হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সুবর্ণজয়ন্তী, সাবেক-বর্তমানদের পদচারণায় মুখর চবি

কেউ এসেছেন স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে, কেউবা এসেছেন একা। অনেকে তো আবার নাতি-নাতনীদেরও সাথে করে নিয়ে এসেছেন। শনিবার (১৫ অক্টোবর) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবে দেখা গেছে এমন চিত্র। `এসো মিলি পঞ্চাশের উৎসবে, গৌরবে অস্তিত্বে অনুভবে’- এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে পালিত হচ্ছে এই উৎসব।

বিভাগটির ১ম ব্যাচ থেকে শুরু করে শেষ ব্যাচ পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেছেন এ উৎসবে। প্রায় ২১‘শ প্রক্তন শিক্ষার্থী, তাদের পরিবারের সদস্য ও বিভাগটির বর্তমান ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকদের অংশগ্রহণে সর্বমোট ৪ হাজার লোকের সমাগম হয়েছিল এ উৎসবকে কেন্দ্র করে।

সরজমিনে দেখা যায়, নানা বয়সের, নানা পেশার লোকেরা এতে এসেছেন এই অনুষ্ঠানে। কেউবা শিক্ষক, কেউ ব্যাবসায়ী, কেউবা সরকারি কোনো বড় অফিসের কর্মকর্তা আবার কেউ আছেন বিদেশের কোনো বড় কোম্পানিতে কর্মরত। কেউ এসেছেন লাঠিতে ভর দিয়ে আবার কেউ এসেছেন পরিবারের সদস্যদের হাত ধরে। দীর্ঘদিন পর মায়া জড়ানো এই প্রাণের ক্যাম্পাসে আসতে পেরে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন অনেকেই। আবার অনেকে প্রিয় বন্ধুদের সান্নিধ্য পেয়ে হয়ে পড়েন উচ্ছ্বাসিত।

সকালে ক্যাম্পাসে প্রবেশের পর পরেই নিজের ব্যাচের সেই পুরোনো বন্ধুদের খুঁজে পেতে মরিয়া হয়ে উঠেন প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা। কাউকে খুঁজে পেলেই দৌঁড়ে গিয়ে কোলাকুলি করছেন তার সাথে। কোলাকুলি করতে করতে একে অপরকে পুরোনো দিনের কোনো ঘটনা মনে করিয়ে দিয়ে একে অপরকে খোঁচা দিচ্ছেন। পরক্ষণেই দেখা গেল পুরোনো কোনো স্মৃতি মনে করতে গিয়ে তাদের চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে কয়েক ফোটা অশ্রু। একসাথে একই ব্যাচের কয়েকজন জড়ো হলেই তুলছেন ছবি। দীর্ঘদিন পর বন্ধুদের সাথে একত্রিত হওয়ার মুহুর্তগুলোকে আজীবনের জন্য জমা রাখতে ছবি তোলার সুযোগটা কেউ হাতছাড়া করতে চাইছেন না।

কেউ ঘুরে ঘুরে দেখছেন বেশ কিছু বছর আগে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে ছেড়ে যাওয়া সেই প্রাণের ক্যাম্পাসকে। হয়তো তারা পরখ করে দেখছেন সেই সময়ের ক্যাম্পাস আর এই সময়ের ক্যাম্পাসের মধ্যে কতোটা তফাৎ। অথবা ভাবছেন, আদৌ কি কোনো পরিবর্তন হয়েছে? এসেছে কি কোনো নতুনত্ব। আবার অনেকে তাদের পরিবারের সদস্যদের ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাচ্ছেন ক্যাম্পাসের একেকটি জায়গা। স্মৃতিকোটায় জমে থাকা ক্যাম্পাস জীবনের হাজারো গল্পগলো তাদের স্ত্রী-পুত্র আর নাতী-নাতনীদের শুনাচ্ছেন। আর তারাও মনোযোগ সহকারে শুনছেন সেই গল্প। গল্প শুনে কখনো কখনো আট্টহাসিতে ফেটে পড়ছেন তারা আবার কখনো তাদের চোখেমুখে নেমে এসেছে বিষাদের ছায়া।

ঘুরতে ঘুরতে দেখা হয় বিভাগটির মাস্টার্স প্রথম ব্যাচের ছাত্র কাজি আহমদ নবীর সাথে। তার সাথে গল্প করতে করতে জানা যায় ৭৪ বছরে পৌঁছে গেছেন তিনি। এসেছেন তার স্ত্রী, পুত্র কন্যা ও কন্যা পক্ষের ২ নাতিকে সাথে নিয়ে। গল্পের এক পর্যায়ে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে আমাদের মাস্টার্স ভর্তি পরীক্ষা হয়েছিল পাকিস্তান আমলে। আর ভর্তি হয়েছিলাম আমরা স্বাধীনতার পর। বন্ধুদের সাথে কতশত স্মৃতি যে জমা হয়েছিল। আমাদের সময় তো আর যোগাযোগ ব্যবস্থা এত উন্নত ছিল না। মাস্টার্স শেষ করে যাওয়ার পর আর বন্ধুদের সাথে খুব একটা যোগাযোগ হয় নি। আমি কল্পনাও করিনি আমার বন্ধুদের সাথে আবার দেখা হবে। হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবের ফলে আমাদের অনেকের সাথে আবার দেখা হয়েছে। আমার মনে হচ্ছে আমি যেন সেই পুরোনো দিনের ক্যাম্পাস জীবনেই ফিরে গিয়েছি।

কক্সবাজার থেকে এসেছেন ২৭ তম ব্যাচের ছাত্র আব্দুল হক। তিনি রামু কলেজের সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। বর্তমানে সেখানেই শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন। কথা হয় তার সাথে। তিনি বলেন, আমাদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা ছিল সব বন্ধুরা আবারও মিলিত হব। অবশেষে তা সম্ভব হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের একদম প্রথম ব্যাচ থেকে শুরু করে সর্বশেষ ব্যাচের সবার সাথেই আমাদের মিলিত হওয়ার সুযোগ হয়েছে। এছাড়া আমাদের ব্যাচের বন্ধুবান্ধবদের সাথেও আমরা মিলিত হতে পেরেছি। এই অনুভূতি সত্যিই বলে বুঝানোর মতো নয়।

সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাবসায় প্রশাসন অনুষদ সংলগ্ন শহীদ মিনার এলাকায় অনুষ্ঠিত হয় আলোচনা অনুষ্ঠান। মোট ৩ পর্বে অনুষ্ঠিত হয় এই অনুষ্ঠান। প্রথম পর্বে ব্যাবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন ও সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবের আহ্বায়ক অধ্যাপক মো: হেলাল উদ্দিন নিজামীর সভাপতিত্বে প্রধান অথিতি হিসবে হিসেবে উপস্থিত থেকে বক্তব্য প্রদান করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার।

তিনি বলেন, হিসাববিজ্ঞান বিভাগসহ আমাদের অনেক শিক্ষার্থীই দেশ বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পদাধিষ্ঠিত আছেন। তারা সেখানে সুন্দরভাবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে আমাদের শিক্ষকরা ছাত্রদের যথাযথভাবে গড়ে তুলতে পেরেছেন। এসময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনগ্রসর মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তির ব্যবস্থা করার জন্য এলামনাইদের নিকট আহ্বান জানান।

এ পর্বে বিশেষ অতিথি হিসেবে আরো বক্তব্য রাখেন, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ওয়াশিকা আয়েশা খান (এমপি), কম্পট্রোলার এন্ড অডিট জেনারেল অব বাংলাদেশ মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী, গগণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সচিব মুহাম্মদ মোহসিন চৌধুরী, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক বেনু কুমার দে। এতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন, হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আইয়ুব ইসলাম।

২য় পর্বে Contemporary Issues of Accouing বিষয়ের উপর স্মারক বক্তব্য প্রদান করেন অধ্যাপক ড. ভবতোষ ব্যানার্জি। তিনি একাউন্টিং রিসার্চ ফাউন্ডেশন, ইন্ডিয়ার সভাপতি ও ইন্ডিয়ান একাউন্টিং এসোসিয়েশনের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট।

৩য় পর্বে স্টার এলামনাই সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হয়। এ পর্বে ৯ ক্যাটাগরিতে সর্বমোট ১২৩ জন স্টার এলামনাইকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। এতে হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আইয়ুব ইসলামের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ একাউন্টিং এসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক এম. হারুনুর রশীদ।

এছাড়া বিকেল ৪ টা থেকে নগরীর জি.ই.সি কনভেনশন হলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও র‍্যাফেল ড্র অনুষ্ঠিত হয়।

এর আগে, গতকাল শুক্রবার (১৪ অক্টোবর) বিকেলে নগরীর এম এ আজীজ স্টেডিয়াম সংলগ্ন জিমনেসিয়াম মাঠে উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও র‍্যালি অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অথিতি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা-উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলে।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।