হুমকির মুখে পারকি সমুদ্র সৈকত

বালু উত্তোলনের মহাৎসব, মাটি কেটে জমিতে বাঁধ নির্মাণ

পারকি সমুদ্র সৈকতের বিষফোঁড়া ক্রিস্টাল গোল্ড সরানো, সৈকতের বালু উত্তোলনের প্রতিবাদ, সৌন্দর্য্য বর্ধনের ঝাউবিথি রক্ষা, বেড়িবাঁধ রক্ষা করতে দিনের বেলায় যারা গলা বড় করে প্রতিবাদ করেছেন রাতের আঁধারে তারাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন পারকি সমুদ্র সৈকতের ক্ষতি সাধনের।

একের পর এক এমন ঘটনাই ঘটছে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ের পর্যটকদের অন্যতম স্থান পারকি সমুদ্র সৈকতে।

পারকি সমুদ্র সৈকতে আটকে থাকা জাহাজ ক্রিস্টাল গোল্ড সরানোর পরই নতুন করে হুমকির শিকার হয়েছে কয়েক শতাধিক ঝাউবিথি কাটার মধ্যদিয়ে। এরপরই শুরু হয়েছে সৈকত থেকে বালু উত্তোলনের মহাৎসব, মাছের ঘেরের পানি বের করতে সৈকতের বাঁধ কাটা, সৈকতের মাটি কেটে নিয়ে লিজ নেওয়া সরকারি জমিতে বাঁধ নির্মাণসহ মাটি বিক্রির। আর এসব কাজে জড়িত রয়েছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এমনটায় জানালেন স্থানীয়রা।

স্থানীয়দের অভিযোগ, যারা পারকিকে রক্ষা করার জন্য দিনের বেলায় প্রতিবাদ করেন তারাই রাতের আঁধারে বালু উত্তোলন, বাঁধ কাটা ও মাটি কেটে বিক্রি করছেন বিভিন্নস্থানে। তাদের ভয়ে কেউ প্রতিবাদও করে না। এক কথায় যারা রক্ষক সাজে তারাই এখন ভক্ষক হয়ে গেছে।

শুক্রবার সকালে পারকি সমুদ্র সৈকতে গিয়ে দেখা যায়, বালু উত্তোলন কাজে ব্যবহৃত কয়েকশত ফিটের পাইপ গেছে সৈকতের বুক ছিড়ে। পাইপ নেওয়ার জন্য কাটা হয়েছে বেড়িবাঁধও। দক্ষিণ পাড়ে মাছের ঘেরের পানি বের করার জন্য কেটে দিয়েছে বাঁধ। বনবিভাগের নিলামে কাটা ঝাউবিথির গাছের গোড়া পড়ে আছে সৈকতের চারদিকে। সৈকতের বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ময়লা আবর্জনা আর গর্ত। এতে পর্যটন সৈকতের সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে, তেমনি সৈকতও ঝুঁকির মুখে পড়ছে।

ক্রিস্টাল গোল্ড :
২০১৭ সালের ৩০ মে ঘূর্ণিঝড় মোরার আঘাতে ক্রিস্টাল গোল্ড নামের জাহাজটি বহির্নোঙর থেকে পারকি সৈকতে উঠে আটকা পড়ে। দীর্ঘদিন সৈকতে থাকার কারণে পারকি সৈকতের আধা কিলোমিটার অংশে পলি জমে যায়। সৈকতের ঝাউগাছ উপড়ে পড়ে। এ কারণে জাহাজটি সরানোর দাবি জানিয়ে আসছিল বিভিন্ন সামাজিক ও পরিবেশবাদী সংগঠন। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পুরো জাহাজ কাটার কাজ শেষ হলে সৈকত ফিরতে শুরু করে আগের সৌন্দর্য্যে।

ঝাউ গাছ :
গত নভেম্বরে সমুদ্রসৈকতে বিভিন্ন সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপড়েপড়া ১৫৫টি ঝাউগাছ নিলামে বিক্রি করেছে চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগ। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে ঠিকাদার শর্ত ভঙ্গ করে সংশ্লিষ্ট বনকর্মীর যোগসাজশে নিলামের দ্বিগুণ গাছ কেটে নেন।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সাগরের ঢেউয়ের তোড়ে গত দুই বছরে পারকি সমুদ্রসৈকতের অন্তত পাঁচ শতাধিক ঝাউগাছ উপড়ে পড়ে। দীর্ঘদিন উপড়ে পড়া গাছগুলো অরক্ষিত অবস্থায় সৈকতজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে ছিল। অনেক গাছ সংশ্লিষ্ট বনকর্মীকে ম্যানেজ করে স্থানীয় লোকজন কেটে নিয়েছে। তাছাড়া সৈকতে লুটিয়ে পড়া গাছগুলোর কারণে সবল গাছগুলোর গোড়ালি থেকে বালু সরে দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে। ঝরেপড়া এসব গাছ কর্তন ও অপসারণের জন্য গত ২৮ আগস্ট দরপত্র আহবান করে চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগ।

কার্যাদেশে, মোট ৬টি লটে ১৫৫টি গাছ বিক্রি করা হয় উৎসে কর ও ভ্যাটসহ ১ লাখ ৮২ হাজার ৭১৩ টাকায়। সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে নিলামটি পায় মেসার্স সেজুতি এন্টারপ্রাইজ নামের আনোয়ারা উপজেলার একটি প্রতিষ্ঠান।

চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. আবদুর রহমান স্বাক্ষরিত কার্যাদেশটি দেওয়া হয় গত ২৫ অক্টোবর। কার্যাদেশে উল্লিখিত আট শর্তের একটি হচ্ছে লট এলাকায় মার্কাকৃত গাছ ছাড়া অন্য কোনো গাছ কাটা যাবে না। কিন্তু কার্যাদেশের শর্ত ভঙ্গ করে সংশ্লিষ্ট বনকর্মীর যোগসাজশে নিলামের চেয়েও অতিরিক্ত গাছ কাটছে প্রতিষ্ঠানটি।

তবে উপকূলীয় বন বিভাগ বলছে, ১৫৫টি গাছ কাটার পর বাকি গাছগুলো নতুন করে নিলাম দেওয়া হবে।

উপকূলীয় বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, পারকি সৈকতের বালিয়াড়িতে প্রথম ১৯৯২-৯৩ অর্থবছরে ১২ হেক্টর জায়গায় ঝাউবন গড়ে তোলা হয়। এরপর ১৯৯৩-৯৪ অর্থবছরে ১৭ দশমিক ২ হেক্টর, ২০০৩-০৪ অর্থবছরে ৫ হেক্টর ও ২০০৪-০৫ অর্থবছরে ৫ হেক্টর জায়গায় ঝাউবাগান করা হয়। চারবারে বালিয়াড়ির মোট ৩৯ দশমিক ২ হেক্টর বা ৯৭ একর জায়গায় লাগানো হয় ঝাউগাছ।

কাটছে বাঁধ :
গত সোমবার (৬ ডিসেম্বর) পারকি সৈকতের লুসাইপার্কের উত্তর পাশে বিশাল মৎস্য ঘেরের ময়লা পচা পানি গুলো বের করার জন্য কেটে ফেলেছে সৈকতের বেঁড়িবাধ ও গাছ। এতে করে ক্ষতির মুখে পড়ে পুরো সৈকত।

সৈকত কেটে ব্যক্তিগত জমির বাঁধ নির্মাণ করায় গত বুধবার রাতে উপজেলা প্রশাসন অভিযান চালিয়ে রায়পুর ইউনিয়নের মোহাম্মদ ফারুক নামে এক ব্যক্তিকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানাসহ জব্দ করা হয় মাটি কাটার কাজে ব্যবহৃত একটি এস্কেভেটর। আর আটক করা হয় দুই চালককে।

হুমকির মুখে পারকি সমুদ্র সৈকত 1
পর্যটন মন্ত্রণলায় পারকি সমুদ্র সৈকতকে আধুনিক বিচ ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে পর্যটন করপোরেশন তিন বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প হাতে নেয়। ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পটির মেয়াদ ধরা হলেও এখনও শেষ হয়নি নির্মাণ কাজ। তবে স্থানীয় প্রভাবশালী একটি চক্র সৈকতের পরিবেশ নষ্ট ও বিচের বুকের পাইপ লাগিয়ে সে বালু নিয়ে যাচ্ছে পর্যটন কর্পোরেশনের ১৩.৩৬ একর জমি ভরাটের কাজে। পারকি সমুদ্র সৈকতে রয়েছে ইঞ্জিনচালিত একটি ড্রেজার। সন্ধ্যা নামলেই শুরু হয় বালু উত্তোলনের কাজ।

শহর থেকে বেড়াতে আসা পর্যটক নুসরাত জাহান ও জানাতুল ফেরদৌস বলেন, পারকি সমুদ্র সৈকতে অনেকবার এসেছি, চরে জমে আছে কাদা মাটি, ময়লা অর্বজনা তার উপরে বালুর পাইপ। এবারের মত অবস্থা আগে ছিলো না। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সৈকতের সৌন্দর্য। এসব বন্ধে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছি।

চট্টগ্রাম বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্য ও স্থানীয় চেয়ারম্যান এম.এ কাইয়ূম শাহ্ বলেন, ক্রিস্টাল গোল্ড সরিয়ে নেয়ার পর সৌন্দর্য্য ফিরে এসেছিল পুরো সৈকত চরের। কিন্তু অসাধু ব্যক্তিরা সৈকতের বিভিন্নস্থানে কেটে ফেলায় আবারও ফিরে এসেছে আগের চিত্রে। সৈকতের বাঁধ কাটায় ক্ষতি হয়েছে সৈকতের চর এলাকা। ভাঙন দেখা দিয়েছি সৈকত এলাকায়। এতে করে সৈকতে আসা পর্যটকরা পড়ছেন বিড়ম্বনায়।

যারা পারকি সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্য্য নস্ট করছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া জন্য প্রশাসনের কাছে আহবান জানাচ্ছি।

তিনি আরো বলেন, আগামী রোববার সকাল থেকে পারকি সমুদ্র সৈকতে সৌন্দর্য্য ফিরিয়ে আনতে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করা হবে।

আনোয়ারা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আবদুল্লাহ আল মুমিন বলেন, সৈকত থেকে মাটি কেটে ব্যক্তিগত জমির বাঁধ নির্মাণ ও সৈকতের সৌন্দর্য ক্ষতি করার দায়ে রায়পুর ইউনিয়নের মোহাম্মদ ফারুক নামে এক ব্যক্তিকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। সৈকতকে রক্ষা করার জন্য এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।