১২শ খামারের বর্জ্য যাচ্ছে কর্ণফুলী নদীতে!

খাল রক্ষায় এগিয়ে আসেনি কেউ

একটা সময় চলতো বড়-বড় সাম্পান, বজরা, ময়ূরপঙ্খী, পালতোলা পানসি, সওদাগরী নৌকা। বিভিন্ন এলাকার মানুষ নিত্যাপ্রয়োজনে পানিও নিয়ে যেতেন এ খাল থেকে। তবে এখন তা শুধুই স্মৃতি। খামারি আর অবৈধ দখলদারের কবলে বিষাক্ত খালে পরিনত হয়েছে চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর শিকলবাহা-চরফরিদ খাল।

উপজেলার শিকলবাহা মাজার গেইট এলাকা থেকে শুরু হয়ে আলী হোসেন মার্কেট পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটার এলাকার খালের দুই পাশে গড়ে উঠেছে গরুর খামার। এসব খামারের কয়েক হাজার গরুর গোবর আর মুত্রের বর্জ্য সরাসরি ফেলা হয় শিকলবাহা খালে। এতে খালটি এখন নোংরা ডোবা ও গোবরের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। খালে ফেলা বর্জ্য থেকে তীব্র দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী। খালের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় উৎকট গন্ধে গা গুলিয়ে যায় পথচারীদের। এতে করে মানুষ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছেন।

শুধু শিকলবাহা-চরফরিদ খাল নয়, বিষাক্ত বর্জ্যে কঠিন অবস্থা কর্ণফুলী নদীও। এই উপজেলায় ১২০০ খামারের বর্জ্যও যাচ্ছে কর্ণফুলী নদীতে।

সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার শিকলবাহা মাজার গেইট এলাকা থেকে শুরু হয়ে আলী হোসেন মার্কেট পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটার এলাকার খালের দুই পাশে গড়ে উঠা গরুর খামারের বর্জ্য সরাসরি ফেলছে খামারীরা। গোবর আর মুত্রের বুঝার কোনো উপায় নেই এটি খাল। অধিকাংশ ডেইরি ফার্মের গোবর ও মূত্র মিশ্রিত দূষিত পানি পাইপ ও ড্রেনের মাধ্যমে সরাসরি খালে ফেলা হয়, যা পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

স্থানীয় বাসিন্দা বৃদ্ধ আবুল কাশেম বলেন, উপজেলার চারদিক ঘিরে বয়ে যাওয়া কর্ণফুলী নদীর সঙ্গে মিলিত ছিল শিকলবাহা-চরফরিদ খালটি। ৯০ দশকের দিকে নৌপথে আনা-নেওয়া করা হতো পণ্য। নৌপথে ছিল বাণিজ্যিক যোগাযোগও। কিন্তু ভূমিদস্যু ও প্রভাবশালীদের দখল-দূষণে এখন সংকটাপন্ন উপজেলার খালগুলো। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা এই খালের। যেন দেখার কেউ নেই।

আব্বাস আলী নামে এক বৃদ্ধ বলেন, ‘ছোটকালে আমরা এই খাল থেকে মাছ ধরেছি, গোসলসহ ব্যবহারের জন্য ঘরে পানিও নিয়ে গেছি। কিন্তু গত একযুগ ধর ভয়াবহ দূষণের কারণে খালে এখন আর খাল নেই, এটি গোবরের খালে পরিনত হয়েছে।’

তবে এ বিষয়ে কোনো খামারি কথা বলতে রাজি হয়নি।

প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের তথ্য মতে, দক্ষিণ চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলায় ১২শ খামার রয়েছে। এসব খামারের বড় একটা অংশ কর্ণফুলী নদীর সাথে সংযুক্ত খালের পাড় কিংবা আশপাশে গড়ে উঠেছে। কর্ণফুলীর খামারগুলোতে ২৫ হাজার গরু রয়েছে। দৈনিক তিন হাজার টন গোবর এবং দুই লাখ লিটার গো-মূত্র ত্যাগের তথ্য দিয়েছেন তারা।

স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগ- খামারিদের পশুর বর্জ্যে ভরাট হয়ে গেছে খালটি। কৃষকরা আগে তাদের চাষাবাদে খালের পানি ব্যবহার করতেন। এখন সেটি সম্ভব হয়না। তাদের দাবি, পশুর বর্জ্যে দূষিত হয়ে খাল-বিল ও জলাশয়কে বিষের খনিতে পরিণত করেছে। এতে চরলক্ষ্যা ও শিকলবাহা ইউনিয়নের কৃষকরা বৃষ্টির পানির ওপর নির্ভর করেই চাষাবাদ করতে হয়।

জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত কর্ণফুলীর খামারি হারুন চৌধুরী বলেন, বিগত সরকার থাকাকালীন সময়ে খালটি খনন করা হয়েছিল। খালের বিভিন্ন স্থানে অপরিকল্পিত কালভার্ট নির্মাণসহ ঠিকাদার যেসব বাঁধ দিয়েছিলো, সেগুলো এখনও রয়ে গেছে। যার কারণে কর্ণফুলী নদী থেকে পানি প্রবেশ করছে না খালে। এছাড়াও মইজ্জ্যেরটেক পশুর বাজারের বর্জ্য ফেলাসহ খালের বিভিন্ন স্থান দখল করে নির্মাণ হয়েছে বিভিন্ন স্থাপনাও। অবৈধ স্থাপনা গুলো উচ্ছেদ এবং খালটি খননে প্রশাসনের সহয়তা প্রয়োজন।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বিডব্লিউডিবি) আওয়াতাধীন শিকলবাহা খালটি এই জনপদকে বর্ষাকালে বন্যার পানি থেকে রক্ষা করে। এছাড়াও কর্ণফুলী ও পার্শ্ববর্তী এলাকার হাজার হাজার কৃষক তাদের সেচের পানি এই খাল থেকেই ব্যবহার করতেন। অথচ দূষণে মৃতপ্রায় এই খাল এখন কৃষকদের কোনো কাজেই আসছে না।

এর দুই বছর আগে চট্টগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি প্রকল্পে ২ কোটি ৪ লাখ ১৫ হাজার টাকা বরাদ্দের পুন:খনন করেন মেসার্স গরীবে নেওয়াজ এন্টারপ্রাইজ নামক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

অপরিকল্পিত খননে কোটি টাকা জলে ফেলা হয়েছে বলেও অভিযোগ স্থানীয়দের। কোটি টাকা খরচ করে খননেও রক্ষা হয়নি খালটি। সে সময়ে খালের প্রায় ৯ কিলোমিটার খনন কাজ নিয়েও অনিয়মের অভিযোগও তুলেছিলেন স্থানীয়রা।

পানি উন্নয়ন বোর্ড নির্বাহী প্রকৌশলী শওকত ইবনে শাহিদ বলেন, ‘পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) খাল পুনঃখননের ডেলটা প্ল্যানের আওতায় খালটি পুনর্জীবিত ও ফসলি জমির চাষাবাদে কৃষকদের উপকারের উদ্দেশে খনন করা হয়েছিল। কিন্তু এরইমধ্যে খালটি পূর্বের অবস্থায় রূপ নিয়েছে। খালটি রক্ষায় পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসনকে এগিয়ে আসা প্রয়োজন।’

কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাসুমা জান্নাত বলেন, ‘খালটি রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

প্রসঙ্গত, ২০২২ সালের ৯ মে শিকলবাহা খালকে দূষণমুক্ত করা ও ডেইরি ফার্ম থেকে সৃষ্ট বর্জ্য জৈব সার হিসেবে ব্যবহারে পরিকল্পনা নিয়ে একটি বিশেষ সভা চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। করা হয় একটি কমিটিও। তবে খাল দূষণমুক্ত করতে নানা পরিকল্পনা নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।