অন্যতম শীর্ষ ঋণখেলাপী শাহাবুদ্দিন ও তার স্ত্রীর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

এস.এ গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান ও দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ঋণখেলাপী মো. শাহাবুদ্দিন আলম ও তার স্ত্রী ইয়াসমীন আলমের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতের বিচারক মুজাহিদুর রহমান। একই আদেশে আগামী ২৩ মার্চ আদালতে তাদের পাসপোর্ট জমা দেওয়ারও আদেশ দেন তিনি।

মঙ্গলবার (১৫ মার্চ) বিষয়টি চট্টগ্রাম খবরকে নিশ্চিত করেন আদালতের বেঞ্চ সহকারী রেজাউল করিম। তিনি বলেন, অগ্রণী ব্যাংকের ১২২ কোটি ৬৫ লাখ ৪৫ হাজার ৩০০ টাকা ঋণের বিপরীতে কোনো স্থাবর সম্পত্তি ব্যাংকে বন্ধক নেই। গত এক দশক এই টাকা পরিশোধে গড়িমসি করছেন শাহাবুদ্দিন আলম ও তার স্ত্রী। অনেক ঋণখেলাপী দেশত্যাগ করা বিভিন্ন ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ আদায়ে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তাই আদালত তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে যে শীর্ষ ঋণখেলাপীদের তালিকা প্রকাশ করেছেন তাদের একজন এই শাহাবুদ্দিন আলম। তিনি হালিশহরের মো. শামসুল আলমের ছেলে। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পালিয়ে বেড়ানো অবস্থা ১৭ অক্টোবর ২০১৮ রাজধানী ঢাকার গুলশান এলাকার একটি হোটেল থেকে শাহাবুদ্দিন আলমকে সিআইডির সদস্যরা গ্রেপ্তার করেছিলেন। তখন ব্যাংক এশিয়ার দায়ের করা একটি মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করলে আদালত তাকে কারাগারে পাঠিয়েছিলেন।

শাহাবুদ্দিন আলমের মোট ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার ৬২২ কোটি ৪৮ লাখ ৪৫ হাজার ৫৯ টাকা। এর মধ্যে চট্টগ্রামের ব্যাংক এশিয়া লিমিটেডের সিডিএ অ্যাভিনিউ শাখা থেকে তার নেওয়া ঋণের পরিমাণ ৭০৯ কোটি ২৭ লাখ ৩৫ হাজার টাকা।

২০১৭ সালের ২৮ অক্টোবর ফারমার্স ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনায় শাহাবুদ্দিন আলম, তার স্ত্রী ইয়াসমিন আলম ও ব্যাংকটির অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতীসহ সাত জনের বিরুদ্ধে রাজধানীর গুলশান থানায় মামলা করেন দুদকের উপপরিচালক সামছুল আলম। মামলার পর দুদক শাহাবুদ্দিন আলম ও তার পরিবারের সদস্যদের সম্পদের অনুসন্ধানে নামে কমিশন।

দেশের ১৬টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির অভিযোগ অনুসন্ধানে ১০টি ব্যাংকের নথিপত্র সংগ্রহ করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। শাহাবুদ্দীন আলমের বিরুদ্ধে ওঠা ঋণ জালিয়াতির অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদক ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের (এফএসআইবিএল) চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ শাখা, ইসলামী ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা, ব্যাংক এশিয়ার সিডিএ শাখা, ঢাকা ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখা, ন্যাশনাল ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা, জনতা ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা, রূপালী ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা, এনসিসি ব্যাংক, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা ও অগ্রণী ব্যাংকের লালদীঘি শাখার ঋণ সংশ্লিষ্ট নথিপত্রের কথা জানিয়েছিল দুদক।
এদিকে ঋণের নামে ফারমার্স ব্যাংক লিমিটেড থেকে প্রায় ৩০ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলাও সাহাবুদ্দীন আলম এবং তার স্ত্রী ও এস এ গ্রুপের মেসার্স লায়লা বনস্পতি প্রোডাক্টস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মিসেস ইয়াসমিন আলমসহ ৭ জনকে আসামি করে মামলা করেছিল দুদক। দুদকের উপপরিচালক শামছুল আলম বাদী হয়ে গুলশান থানায় মামলাটি দায়ের করেন।
দুদক জাল-জালিয়াতি ও ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে অপর্যাপ্ত জামানতের বিপরীতে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে।

দুদকের অভিযোগে বলা হয়, বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে এসএ গ্রুপের ঋণ রয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের (এফএসআইবিএল) আগ্রাবাদ শাখায় প্রতিষ্ঠানটির ঋণ রয়েছে ৪৮১ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির কাছে ইসলামী ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখার পাওনা রয়েছে ৪২৩ কোটি টাকা। ৩৩৮ কোটি টাকা পাবে ব্যাংক এশিয়ার সিডিএ শাখা। এছাড়া ঢাকা ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখায় ২৪৭ কোটি টাকা, পূবালী ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় ২৮৮ কোটি টাকা, ন্যাশনাল ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় ২২১ কোটি, জনতা ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় ২০০ কোটি, রূপালী ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় ১৫১ কোটি, অগ্রণী ব্যাংকের লালদীঘি শাখায় ১১৮ কোটি, কৃষি ব্যাংকের ষোলশহর শাখায় ১০০ কোটি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখায় সাড়ে ৫৩ কোটি, উত্তরা ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় ৫২ কোটি, প্রাইম লিজিংয়ের ৩৬ কোটি, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় ১৪ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির।

এর বাইরে আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইডিএলসির কাছেও বড় অংকের ঋণ রয়েছে এসএ গ্রুপের। এসএ গ্রুপের অধীনে তেল পরিশোধন, খাদ্য পণ্য, দুগ্ধজাত খাদ্যপণ্য, পানীয়, সিমেন্ট, বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বাজারে এই গ্রুপের পরিচিত পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে গোয়ালিনি কনডেন্সড মিল্ক, গুঁড়ো দুধ, মুসকান ড্রিংকিং ওয়াটার, সয়াবিন তেল, ঘি, আটা, ময়দা ইত্যাদি। গত কয়েক বছরে এসএ গ্রুপের কর্ণধারদের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের বিভিন্ন আদালতে শতাধিক মামলা করেছে পাওনাদার বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এগুলোর বেশির ভাগই চেক ও অর্থঋণ সংক্রান্ত।

তবে শীর্ষ এই ঋণখেলাপী শাহাবুদ্দিন আছেন এক প্রকার নির্ভার। ব্যাংকের টাকা মেরে শীর্ষ ঋণখেলাপীর তালিকা উঠে আসলেও চট্টগ্রামের একমাত্র পাঁচ তারকা হোটেলে অনুষ্ঠান করে এবি ব্যাংকের সাথে চুক্তি করেছেন তার কোম্পানীর লেনদেনের জন্য। আবার চলতি মার্চ মাসেও চট্টগ্রামে এসএ গ্রুপের সৌজন্যে একটি স্কোয়াশ টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়েছে।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।