অবৈধ করাতকলে উজাড় হচ্ছে পাহাড়ি বন

পাবর্তজেলা রাঙামাটির প্রায় প্রতিটি উপজেলায় চলছে সরকারের অনুমোদন ছাড়াই অসংখ্য করাতকল। এসব কলে সাবাড় হচ্ছে বনজ, ফলজ, নানা প্রজাতির গাছ সহ প্রাকৃতিক বন। সরকারের নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে অবৈধভাবে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশে গড়ে ওঠা ওইসব করাত কলের শব্দ দূষণের ফলে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে।

জানা গেছে, শুধু লংগদু উপজেলায় ৭টি ইউনিয়নে ৩০টি করাতকল রয়েছে। তার মধ্যে একটি করাতকলের লাইসেন্স আছে। অনুমোদনহীন করাতকলের মধ্যে লংগদু সদর ইউনিয়নে ৭টি, মাইনীমূখ ইউনিয়নে ৮টি, আটারকছড়া ইউনিয়নে ৭টি, গুলশাখালী ইউনিয়নে ২টি, বগাচতর ইউনিয়নে ৩টি এবং ভাসান্যাদম ইউনিয়নে ৩টি করাতকল রয়েছে। আর চিত্র প্রায় প্রতিটি উপজেলার

সোমবার উপজেলার বাইট্টাপাড়া, আলতাফ মার্কেট, ইসলামাবাদ ও আটারকছড়া এলাকা ঘুরে যত্রতত্র অবৈধ করাতকল স্থাপন করতে দেখা গেছে।

দেখা গেছে, কল মালিকরা সরকারি নিয়ম মানছেন না। অনেকেই ১৫-২০ বছর ধরে অনুমোদন ছাড়াই চালাচ্ছেন কল। কলের চত্বরে মজুত রাখছেন বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। ভোর থেকে শুরু করে মধ্যরাত পর্যন্ত চলছে কাঠ কাটার কাজ। সরকারের অনুমোদনহীন এসব অবৈধ কলগুলো বন্ধ করার কোনো উদ্যোগও চোখে পড়েনি।

করাতকল স্থাপনে লাইসেন্স নিতে হয় বন বিভাগ থেকে। লাগে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র। মানতে হয় আরো কিছু নির্দিষ্ট বিধিমালা।

করাতকলের অনুমোদন পেতে হলে বেশ কিছু বিষয় বিবেচনা করা হয়। করাতকল বিধিমালা-২০১২ তে বলা আছে, বিশেষ করে সংরক্ষিত, রক্ষিত, অর্পিত বা অন্য যে কোন ধরনের সরকারি বন ভূমির সীমানা হতে নূন্যতম ১০ কিলোমিটারের মধ্যে করাতকল স্থাপন করা যাবে না। এছাড়া কোনো সরকারি অফিস—আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, বিনোদন পার্ক, উদ্যান এবং জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এরূপ কোনো স্থানের নূন্যতম ২০০ মিটারের মধ্যে করাতকল স্থাপন করা যাবে না। এই নির্দেশনা মানা হচ্ছে না কোথাও।

এসময় বাইট্টাপাড়ায় বাবুলের করাত কলে গিয়ে দেখা যায় কাঠ চেরাইয়ের কাজে ব্যস্ত শ্রমিকরা। এই করাতকলের চারপাশে অসংখ্য বড় বড় গাছের গুড়ি স্তুপ করে রাখা হয়েছে। এসব গাছের প্রায় সবগুলোই প্রাকৃকি বন থেকে সংগ্রহ করা। এছাড়াও এই করাত কলের একশ গজের মধ্যে রয়েছে একটি ইবতেদায়ী মাদ্রসা ও মসজিদ। এবং এটি একটি আবাসিক এলাকা।

স্থানীয় মাদ্রাসা শিক্ষার্থী মো. সোহাগ মিয়া বলেন, দিনরাত করাতকলের শব্দের কারণে ক্লাস করতে খুবই সমস্যা হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকার এক করাতকল মালিক বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আমাদের কল চলছে। অনুমোদনের জন্য আবেদন করেছি, এখনো অনুমোদন পাইনি। বন বিভাগের লোকজনকে ম্যানেজ করে মিল চালাচ্ছি।

এভাবে সরকারের অনুমোদনবিহীন করাতকল চলায় একদিকে পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে, বন উজাড় হচ্ছে; অপরদিকে সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

উপজেলা করাতকল মালিক সমিতির সভাপতি রহমত আলী জানান, কয়েকটি করাতকলের অনুমোদন আছে বাকিগুলো অনুমোদনের জন্য আবেদন করেছে। আশা করি শীঘ্রই লাইসেন্স পেয়ে যাবে।

সচেতন নাগরিকরা বলছেন, পার্বত্যাঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ এখন হুমকির মুখে। নির্বিচারে বনাঞ্চল উজার হচ্ছে। তামাকচুল্লি ও ইটভাটায় পুড়ছে শতশত টন কাঠ। বন্য প্রাণির আশ্রয়স্থল উজারের ফলে লোকালয়ে খাবারের সন্ধানে আসছে হাতি, বানর ও হনুমান। এতে প্রায় সময় মানুষের জানমালের ক্ষতি হচ্ছে। উন্নয়নের অজুহাতে বৃক্ষ নিধন ও পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হবে এবং আইন প্রয়োগে প্রশাসনকে আরো বেশি কঠোর হতে হবে।

এ বিষয়ে লংগদু বন বিভাগের উল্টাছড়ি রেঞ্জ কর্মকর্তা সাজিব মজুমদার বলেন, অবৈধ করাতকলের বিরুদ্ধে উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় আমরা অভিযান অব্যাহত রেখেছি। ইতোমধ্যে অনেকগুলো করাতকলে অভিযান চালিয়ে জেল জরিমানা করা হয়েছে। প্রয়োজনে আবারো অভিযান চালানো হবে এবং অনুমোদনহীন করাতকল বন্ধ করতে দ্রুত ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও বনায়ন কমিটির সভাপতি আকিব ওসমান বলেন, দ্রুত এসব অবৈধ করাতকল উচ্ছেদে অভিযান চালানো হবে। ইতোমধ্যে কয়েকটি করাতকলে অভিযান চালিয়ে জরিমানা করা হয়েছে।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।