আনোয়ারা-কর্ণফুলীতে হাতি আতঙ্ক

আবাসস্থল সংকট

‘পাহাড় কেটে সাবাড়, জঙ্গল গিলছে শিল্প। ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে বন্যপ্রাণীদের আবাস। সন্ধ্যা হলেই গ্রামের মানুষ আতঙ্কে সিঁটিয়ে থাকেন। সারা দিন পরিশ্রম করে ভাত খেতে বসতেই চারদিক থেকে হাঁকডাক ‘হাতি আসতেছে’।

উঠানে এসে পায়চারি করে বুনো হাতি। কখনো হাতির পাল তছনছ করে যায় ফসল। আচমকা হাতির সামনে পড়ে চোখের সামনে বেঘোরে প্রাণ হারান আপনজন।

দৃশটি চট্টগ্রাম নগরীর শহরতলী আনোয়ারা-কর্ণফুলী উপজেলার। যা এখন হাতির গ্রামে পরিণত হয়েছে। দুর্গম বনাঞ্চল ও পর্যাপ্ত চাষাবাদ এবং খাবার না থাকলেও হাতির পাল শহরতলীর এ উপজেলাকে স্থায়ী বসতি হিসেবে বেঁচে নিয়েছে।

হাতি আতঙ্কে রাতে ঘুমাতে পারছে না এ দুই উপজেলার বাসিন্দারা। দিনের বেলায় হাতির অবস্থান কেইপিজেডের জলাশয় ও বাগানে হলেও রাতে লোকালয়ে ঘর-বাড়িতে হামলা চালায় খাবারের খোঁজে। প্রতিনিয়ত ঘটছে হতাহতের ঘটনা আর ধ্বংস করছে বাড়িঘর।

পাহাড় কেটে সাবাড়, জঙ্গল গিলছে শিল্পকারখানায়। আর ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে বন্যপ্রাণীদের আবাস। ফলে মানুষ-হাসি একে অপরের শত্রু ১ যুগ ধরে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, দেয়াং পাহাড় ও আশপাশের এলাকায় ১২ বছর ধরে চলছে বন্যহাতি আতঙ্ক। চুনতি অভয়ারন্য থেকে বাঁশখালীর পাহাড়ি এলাকা হয়ে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ও আনোয়ারায় ঢুকে কিছুদিন পরপরই তাণ্ডব চালায় বন্যহাতির দল। ২০১০ সালের পর থেকে ১২ বছরে হাতির আক্রমণে কর্ণফুলী ও আনোযারায় অন্তত ১৭জন মারা যাওয়া ছাড়াও ৫০-৭০ জন হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।

কেইপিজেডের পাহাড়ে অবস্থান করা হাতির তাণ্ডবে পাহাড়ের আশপাশে দুই উপজেলার মানুষের মাঝে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে এলাকাবাসী। পথ হারিয়ে বন্যহাতির পাল হানা দিলেও এবার সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে হাতিগুলো দেয়াঙ পাহাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হাতিগুলো তাড়াতে আধুনিক কোন প্রযুক্তি না থাকায় বনবিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছেন হাতি তাড়াতে।

বনবিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, চুনতি অভয়ারণ্যে ৪২টি ও আশপাশের পাহাড়ি এলাকা মিলিয়ে ৪৭টি বন্যহাতি রয়েছে। এই হাতিগুলোর মধ্য থেকে পথ হারিয়ে দেয়াঙ পাহাড়ে ঢুকে পড়ছে হাতির দলটি।

বন্যহাতি ঢুকলো কীভাবে :
বন বিভাগের কর্মকর্তাদের ধারণা চুনতি অভয়ারণ্য থেকে পথ হারিয়ে ২০১০ সালের দিকে বাঁশখালীর পাহাড়ি এলাকা হয়ে বন্যহাতি দেয়াঙ পাহাড়ে ঢুকেছে। পর্যাপ্ত খাদ্য না পাওয়া ও নিজের আবাসস্থলে পৌঁছতে না পারায় হাতিগুলো লোকালয়ে চড়াও হচ্ছে। সাধারণত দিনের বেলায় হাতি পাহাড়ে থাকলেও রাত নামলেই চলে আসছে গ্রামে। এ সময় ঘরবাড়ি ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করছে।

বাঁশখালীর পাহাড় থেকে হাতির দল গত ১২ বছর ধরে দেয়াঙ পাহাড়ে অবস্থান নেয়। খাদ্যের সন্ধানে হাতিগুলো সন্ধ্যা হলেই কর্ণফুলী উপজেলার বড়উঠানের খিলপাড়া, খতিবপাড়া, মাইজপাড়া, বড়উঠান, দৌলতপুর, দক্ষিণ শাহমীরপুর এলাকাসহ আনোয়ারার বারশত ইউনিয়নের কবিরের দোকান, পশ্চিমচাল, কান্তিরহাট, বটতলী ইউনিয়নের জয়নগর, ছিরাবটতলী, গুচ্ছগ্রাম, জয়নালপাড়া, বৈরাগ ইউনিয়নের দেয়াং বাজার, উত্তর গুয়াপঞ্চক, মধ্যম গুয়াপঞ্চক, খাঁনবাড়ী, মোহাম্মদপুর, বদলপুরা, বন্দর, বারখাইন ইউনিয়নের হাজীগাঁও লোকালয়ে প্রবেশ করে বাড়িঘর ভাঙচুর চালিয়ে ফসল নষ্ট করে থাকে।

সূত্র জানায়, বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্যগুলো উজাড় হওয়ার কারণে লোকালয়ে ঢুকে পড়েছে। গত কয়েক বছরে অন্য সময়ের তুলনায় শীত মৌসুমে চরম খাদ্য সংকটে পড়ছে বন্যহাতিরা। এতে প্রতি বছর শীতের শুরুতেই খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে হানা দিচ্ছে বন্যহাতি পাল। এতে রোপণ করা কলাসহ ফলজসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা, ক্ষেতের পাকা ধান খেয়ে থাকে হাতির পাল।

সংরক্ষিত বনগুলোতে গাছ নিধন, পাহাড়ে পাথর ও মাটি উত্তোলনসহ হাতি চলাচলের পথে লোকালয় গড়ে তোলাতে সংকুচিত হয়েছে হাতির আবাস্থল। সম্প্রতি এসব এলাকায় বেড়েছ হাতি-মানুষ সংঘর্ষও। এজন্য মানুষ দ্বারা বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্যগুলো বিনষ্ট করাকেই দুষছেন গবেষকরা। পাশাপাশি বসতবাড়ি গুড়িয়ে দেয়াসহ বাড়ছে মানুষ-হাতি সংঘর্ষ।

গবেষকদের মতে, হাতি তাদের চলাচলের পথে কোনো ধরনের বাধা সহ্য করেনা। প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়লে তারা সেটা উপড়ে ফেলার চেষ্টা করে। নয়তো লোকালয়ে চড়াও হয়। একপথ দিয়ে একবার গেলে সেটি একশ বছর পর্যন্ত মনে রাখার স্মৃতিশক্তি রয়েছে হাতির। হাতি কখনও ইচ্ছে করে মানুষের ক্ষতি করে না।

বনবিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, হাতি তাড়ানোর আধুনিক কোন প্রযুক্তি এ মুহুর্তে বনবিভাগের কাছে নেই। প্রযুক্তিগত পিছিয়ে থাকার কারণে হাতিগুলো সরিয়ে নিতে ফটকা, আগুন জ্বালানো ও উচ্চস্বরে বাঁশি বাজানো ইত্যাদি পুরনো কৌশলের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। তবে ২০১০ সাল থেকে ক্ষতিগ্রস্ত আনোয়ারা-কর্ণফুলী উপজেলার বহু ক্ষতিগ্রস্তকে ক্ষতিপূরণও দিয়েছে বনবিভাগ।

স্থানীয়দের অভিযোগ, এত ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির পরও বন বিভাগ এখনও পর্যন্ত কোন কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। বনবিভাগও ক্ষতিপূরণ দিয়েই দায় সারছে। হাতি সরানোর উদ্যোগ নিচ্ছে না। বরং ভাঙচুর ও ক্ষতি হলে পরামর্শ হিসেবে জিডি করতে বলা হয় ক্ষতিগ্রস্তদের। এ নিয়েও পোহাতে হয় নানা ভোগান্তি।

গত বুধবার দুপুরে আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইউএনও কার্যালয়ে আনোয়ারায় হাতির আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত ২১ পরিবারকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছে বনবিভাগ। আনোয়ারা উপজেলা প্রশাসন, বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের আয়োজনে চেক বিতরণ অনুষ্ঠানে এসব চেক হস্তাস্থর করে।

এ সময় বাঁশখালীর জলদির রেঞ্জ কর্মকর্তা আনিসুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, বন বিভাগের উদ্যোগে বন্যহাতির আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত ২১ পরিবারকে ৩ লাখ ৪৫ হাজার টাকার চেক দেওয়া হয়েছে।

কর্ণফুলী উপজেলার বড়উঠান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ দিদারুল আলম বলেন, ২০১১ সাল থেকে বড়উঠান ইউনিয়নের ৪ জন মারা গেছেন হাতির আক্রমণের শিকার হয়ে। আহত হয়েছেন প্রায় ৫০-৬০ জন। এতে প্রত্যককে ১ লাখ টাকা করে এবং সর্বশেষ একজনকে ৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছে বনবিভাগ। বিগত ১২ বছর ধরে হাতির তান্ডবের শিকার এ উপজেলার মানুষ।

তিনি আরো বলেন, হাতির তাণ্ডবে পাহাড়ের আশপাশে দুই উপজেলার মানুষের মাঝে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে এলাকাবাসী। এমন পরিস্থিতিতে কর্ণফুলীতে বন্যহাতি ও মানুষের মধ্যে তৈরি হওয়া দ্বন্দ্ব নিরসনের চট্টগ্রাম দক্ষিণ বনবিভাগ সঙ্গে জেলা প্রশাসক, কেইপিজেড কর্তৃপক্ষসহ একটি বৈঠক হয়েছিলো। বৈঠকে বনবিভাগ জানিয়েছে তারা হাতি তাড়ানোর জন্য পদক্ষেপ নিবেন। তবে এখনও পর্যন্ত তাদের কোনো পদক্ষেপ আমরা দেখিনি।

আনোয়ারা উপজেলার বৈরাগ ইউনিয়নে চেয়ারম্যান নোয়াব আলী বলেন, হাতিগুলো প্রতিবছর খাবারের খোঁজে আসলেও চলে যেত। বিগত ৫-৬ বছর ধরে এখানে অবস্থান করছেন৷ দিনে পাহাড়ে থাকলেও সন্ধ্যা হলে চলে আসে লোকালয়ে। এ পর্যন্ত হাতির আক্রমনে আমার ইউনিয়নসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ মারা গেছে প্রায় ১৭ জনের মত। বনবিভাগ ক্ষতিপূরণ দিলেও হাতি তাড়ানোর জন্য কোনো ব্যবস্থা এখনও পর্যন্ত নেননি। এসব বিষয়ে আমরা মাননীয় ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এমপি মহোদয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে জানিয়েছি।

জলদী অভয়ারণ্য রেঞ্জ কর্মকর্তা ও বাঁশখালী ইকো পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মু. আনিসুজ্জামান শেখ বলেন, আনোয়ারা-কর্ণফুলীতে ৪টি হাতি অবস্থান করছেন। হাতির আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্তদের বনবিভাগ ক্ষতিপূরণ গুলো আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের হস্তান্তর করি। হাতিগুলো তাড়ানোর জন্য ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করছে।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।