আমাদের কোর্ট বিল্ডিং: স্মৃতি ও ভাবনার পবিত্র সৌধ

গাঙচিলের ঝাঁকে উঁকি দেয় লাল দালান
শীতকাল, পড়ন্ত বিকেলে পশ্চিমে হেলে পড়া সূর্য -কমলা রঙের রোদ-হিমালয়ের ওপার থেকে একটু উঞ্চতার তাগিদে ছুটে আসা অসংখ্য গাঙচিলের ঝাঁক। দূরে লাল রঙের কোর্ট বিল্ডিং। সাম্পানের ক্যাঁকুরুত ক্যাঁকুরুত শব্দ, সবকিছু ছাপিয়ে যে কেউ আনমনা হয়ে পড়বে। ঠিক যে জায়গাটাতে নতুন কর্ণফুলী ব্রিজ সেই দিকে আমরা ছোট বেলায় নদী পাড়ি দিয়ে গ্রামে যেতাম। কর্ণফুলীর মাঝামাঝি গিয়ে শহরের দিকে দৃষ্টি ভাসিয়ে দিলে লাল দালানটি সবার আগে চোখে পড়ত। শংকরের উপন্যাসে পাঠককে যেভাবে কোর্ট চেনানো হয়েছে ঠিক সেভাবে আমার কোর্ট চেনা নয়। ছোটবেলায় অনেক মুরুব্বীরা বিনম্র ভাব নিয়ে শ্রদ্ধাভরে লাল দালানটি চিনিয়ে দিতেন বলতেন ‘চ চ, আঁরার কোর্ট বিল্ডিং দেহা যার (দেখ দেখ, আমাদের কোর্ট বিল্ডিং দেখা যায়)। ভাবতাম- সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ দালান বলেই হয়তো সবচেয়ে উঁচু জায়গাতেই এর অবস্থান। তখনো জানতাম না -কোর্ট হিলের চেয়ে উঁচু পাহাড় চট্টগ্রামে আছে। কোর্ট বিল্ডিং বলতে কি বুঝায় তাও জানা ছিল না। তবে ধারণা করতাম হয়ত ঐ দালানটাই শহরের প্রাণকেন্দ্র। থানা-পুলিশ, কোর্ট-কাছারি বলতে এই দালানটাকেই বুঝতাম।

দেবদূতের শুভাশিস ও রূপসী চাটগাঁ
বিচারক হিসেবে কাজ করতে এসে কোর্ট বিল্ডিং-কে ঘিরে ছেলেবেলার অজস্র স্মৃতি মনের আকাশে উদয় হয়। মাধ্যমিক পর্যায়ে চট্টগ্রাম সরকারী মুসলিম হাই স্কুলে পড়ার সুবাদে প্রায়শ এই পাহাড়ে উঠতাম। যে জায়গা জুড়ে এখন সি.জে.এম. কোর্ট সে জায়গাটা খোলা ছিল। যতটুকু মনে পড়ে কয়েকটি বেঞ্চ পাতা ছিল সেখানটায়। সকাল বিকাল বেড়াতে আসা মানুষগুলো আরাম করে বসতে পারত। ওখানে এসে দক্ষিণ পশ্চিমে তাকালেই চট্টগ্রাম শহরে স্বর্গীয় সৌন্দর্য্য চোখের সামনে ফুটে উঠত। অপরূপ কর্ণফুলী-ওপারের গ্রামীণ আবহ-পাহাড়ের হাত-ছানি , এক চিলতে সাগরের ঝলক- হৃদয়কে অদ্ভুত ভাল লাগায় আবিষ্ট করে ফেলত। যার আবেশ স্মৃতি হাতড়ে হৃদয়ের সূক্ষ্মতম অনুভূতিতে আজও অনুভব করি। শীতের গোধূলি-লগ্নে পূর্বাকাশে তাকালে চোখের সামনে ভেসে উঠত জঞ্জাল পোড়ানো আগুনের কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া- যেন কোন দেবদূতের রেখে যাওয়া শুভাশিস।

কল্যাণমুখী ডিসি অফিস ও ঐতিহ্য রক্ষা
সকাল বিকাল হাঁটার জন্য কিংবা যাঁরা চট্টগ্রামে বেড়াতে আসতেন তাঁদের কাছে এই স্থানটি ছিল খুবই পছন্দের। অথচ ওখানে বর্তমানে টিনের ছাউনি দেয়া যে স্থাপনাগুলো হয়েছে, সেগুলো না কোর্টের জন্য ভাল হয়েছে না কাজের পরিবেশের জন্য! মাঝখানে চিরতরে হারিয়ে গেল নান্দনিকতা ঘেরা চমৎকার একটা জায়গা । সেই সাথে শেষ হয়ে গেল- পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনাময় একটি স্পট। সি.জে.এম. কোর্টের জন্য নির্মিত অস্থায়ী স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ করে হারিয়ে যাওয়া সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব। সি.জে.এম. কোর্টের জন্য প্রস্তাবিত ভবনটি পাহাড়ে নির্মাণ না করে ডিসি অফিস সরিয়ে নিয়ে পুরো লাল দালানটা সংস্কার করে বৈচারিক কার্যক্রমের জন্য ব্যবহার করা যায়। ঐতিহ্যগত ভাবে এই দালানটা কোর্ট বিল্ডিং বলে পরিচিত। কাজেই প্রশাসনও ব্যাপারটাতে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে সহায়তা করবে বলে আশা করা যায়। কিছুদিন পূর্বেও ডি.সি. অফিসের কার্যক্রম অস্থায়ীভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পুরাতন ভবনে চলেছিল। তখন কোন সমস্যা হয়েছে বলে শুনা যায়নি বরং অভ্যাগত নারী,বৃদ্ধ ও অসুস্থ ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ সুবিধা হয়েছিল। কোর্টে উঠার পথে যানজটও কমে গিয়েছিল। আদালতে লোকজন আসে মূলত মামলা সংক্রান্ত কাজে। আর জেলা প্রশাসনে অভ্যাগতরা ভিন্ন ভিন্ন কাজ নিয়ে আসে। স্বাভাবিকভাবে আদালতের চেয়ে জেলা প্রশাসনে আগত মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। কাজেই পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার্থে এবং জনমুখই প্রশাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গিকার পূরণে ডি.সি. অফিসকে জরুরি ভিত্তিতে অন্য কোথায়ও সরিয়ে নিলে মানুষের জন্য কল্যাণকর হবে। এসব কথায় অনেকেই হয়ত বিচার বিভাগ এবং প্রশাসনের ভেতর দ্বন্দ্ব খুঁজে বেড়াবেন। সত্যি বলতে কি- একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে একান্তই সাধারণ ভাবনা থেকে এই কথাগুলো বলে ফেলা।

কালো কোর্ট গাউন ও ব্রতচারী সমাচার
স্কুলে পড়ার সময় পরীর পাহাড়ের আঁকা বাঁকা পথ ধরে উঠতে গেলে চোখে পড়ত- কিছু মানুষ কালো কোট পরে এদিক সেদিক আসা যাওয়া করছেন। কারো কারো গায়ে গাউনও দেখতাম। কেমন অদ্ভুত গাম্ভীর্যপূর্ণ এই মানুষগুলোর চলাফেরা। তখনো আইন পেশা সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না। মাঝে মাঝে ভাবতাম- এই মানুষগুলো বিশেষ কোন ধর্মের ধর্মীয়-গুরু। এঁদের কারো কারো পিছনে দেখতাম দলবেঁধে লোকজন ছুটছে; আর তাঁরা আশেপাশের দুই এক জনের সাথে টুকটাক কথা বলতেন অথবা এদিক সেদিক মাথা নাড়তেন। মনে হতো- সদা প্রার্থনায় রত, অতি কথনে যেন ধ্যান ভেঙ্গে যাবে!

ক্রসকান্ট্রি ও অধুনালুপ্ত স্বর্গীয় সিঁড়ি
ঐতিহাসিক লালদীঘির ময়দান আমাদের স্কুলেরই খেলার মাঠ। আমরা এই মাঠ থেকে দ্রুত গতিতে হাঁটা শুরু করতাম। জহুর হর্কাস মার্কেটে ঢুকে পশ্চিম প্রান্তের গোল চত্বরটাতে চলে আসতাম। এই চত্বরটার দক্ষিণ প্রান্তে মসজিদ ঘেঁষে চমৎকার একটা সিঁড়ি পাহাড় বেয়ে কোর্ট বিল্ডিং-এ উঠে এসেছিল। পাহাড়ের গা জড়ানো এই সিঁড়িকে মনে হতো স্বর্গীয় সোপান। এই সিঁড়ি ভেঙ্গে কোর্ট বিল্ডিং-এর পিছনের রাস্তা ধরে সোজা নিচে নেমে স্কুলে চলে যেতাম। এই রোমাঞ্চকর যাত্রাটাকে আমরা বন্ধুরা ক্রসকান্ট্রি বলতাম। কি যে ভাল লাগত!
পিছনের রাস্তাটা নতুন আদালত ভবনের বিল্ডিং আর্কিটেকচারের মধ্যে রেখে কায়দা করে বাঁচিয়ে(?) রাখা হয়েছে। তবে রাস্তাটির প্রকৃতিগত সৌন্দর্য্যরে দুঃখজনক মৃত্যু ঘটেছে। আর সেই ক্রসকান্ট্রির স্মৃতি বিজড়িত সিঁড়ি আগামী প্রজন্ম হয়ত ইতিহাসের পাতায় খুঁজে বেড়াবে।

প্রাণ জুড়ানো মসজিদ ও স্মৃতিপটে হযরত আমানত শাহ (রহ্ঃ)
অনেকবার নামাজ পড়েছি কোর্ট মসজিদে। পাবলিক লাইব্রেরীতে হযরত আমানত শাহ (রহ্ঃ) -এর জীবনী পড়ে তাঁর কারামতের পবিত্র স্মৃতি হৃদয়ে জ্বল জ্বল করত। মসজিদের সিঁড়ি দিয়ে ওঠা নামার সময় কৈশোর মন কল্পনা করত- যেন এই সিঁড়ির ধাপ গুনে বিপদগ্রস্ত সেই মানুষটিকে তিনি নামতে বলেছিলেন। নির্ধারিত ধাপ নামার পর সেই ব্যক্তিটি দেখতে পেল সে তার নিজের বাড়ীতে। পরে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় দলিল দাখিল করে নিজের মামলা জিততে বা রক্ষা করতে পেরেছিলেন। এই কাহিনীটা কিছুটা পরিবর্তিত ভাবে বিভিন্ন বইতে পড়েছি। তবে মূল মর্ম অনেকটা একই রকম।
বর্তমানে এত সুন্দর- ছায়া ঘেরা শীতল পরিবেশে খুব কম মসজিদই আছে।

অম্ল-মধুর পেশাগত বিতর্ক এবং অতঃপর…
মাঝে মাঝে সুযোগ বুঝে লোকজনের ভিড় ঠেলে এজলাসের বেঞ্চগুলোতে বসে পড়তাম। বিচারকার্যের কিছুই বুঝতাম না। কোন কোন সময় লক্ষ্য করতাম দুইপক্ষের আইনজীবী তুমুল বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পর দেখতাম উভয়ে পরস্পরের সাথে হাসি মুখে কথা বলতে বলতে এজলাস কক্ষ ত্যাগ করছেন। পেশাগত দায়িত্ব এবং ব্যক্তিগত সম্পর্কের অপূর্ব সমন্বয়! অবুঝ মক্কেলকে দেখেছি নিজের নিযুক্ত আইনজীবীকে শাসাতে, ‘আঁর বিরুদ্ধে কোডত এদিন হথা হইয়ে ঈবারলাই য়াসি য়াসি হথা হইতা লাইয়ুন!’(আমার বিরুদ্ধে কোর্টে এতগুলো কথা বলেছেন, তাঁর সাথে হেসে হেসে কথা বলছেন!) একদিন সত্যি-সত্যি বিষয়টা ভাবনায় ফেলেছিল। স্কুলের শিক্ষককে জিগ্যেস করলাম, ‘স্যার, উকিল সাহেবরা মক্কেলের গোপন কথা ফাঁস করে না? ’ স্যার গভীর আত্মবিশ্বাসের সাথে বললেন, ‘না, কখনোই না ।’

এমন বারটি কোথায় খুঁজে পাবে নাকো তুমি
বিচারক হিসেবে ২০০৮ সালের মে মাসে সি.এম.এম. আদালতে জয়েন করার পর আইনজীবীদেরকে খুব কাছ থেকে দেখার এবং বুঝার সুযোগ হয়েছে। কোর্টের প্রতি চট্টগ্রামের আইনজীবীরা খুবই শ্রদ্ধাশীল। কোন আদেশ নিজেদের পক্ষে যাক কিংবা বিপক্ষে যাক- কিন্তু তাঁদের চেহারা বা অভিব্যক্তিতে কোন নেতিবাচক পরিবর্তন আসে না।
আদেশ যাই হোক হাসি মুখে ‘much obliged’ এজলাস বলে কক্ষ ত্যাগ করেন। অন্য জেলাতেও চাকুরী করেছি। কিন্তু এতটা সহিঞ্চুতা, পেশাদারিত্ব ও সম্মানবোধ কোথায় চোখে পড়েনি। এমনিতে চট্টগ্রামে অফিসাররা অত্যধিক সম্মানের পাত্র। কোর্টের প্রতি আইনজীবীদের যে শ্রদ্ধাবোধ তা হয়ত এই ঐতিহ্যেরই ধারাবাহিকতা। এটা বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে বিরল।
মেধা- প্রজ্ঞা, ম্যানার্স-ইটিকেট, নৈতিক মূল্যবোধ ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা- সবদিক থেকে চট্টগ্রাম বার অনন্য। ভূমি আইন, সাংবিধানিক আইন, ফৌজদারী আইন, ভূমি জরিপ আইন, শ্রম আইন এবং হিন্দু আইন প্রভৃতি বিষয়ে তথ্যসমৃদ্ধ পুস্তক রচনা করে এই বারের আইনজীবীরা আইন চর্চা ও আইন পেশায় অসামান্য অবদান রেখেছেন।
বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের পর পূর্ব অভিজ্ঞতাহীন বিচারকগণকে এই বারের আইনজীবীরা যে সহায়তা প্রদান করেছেন এবং আজ পর্যন্ত অব্যাহত রেখেছেন তা সমগ্র জাতির জন্য অনুকরণীয় ও প্রেরণাদায়ক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। বিজ্ঞ আইনজীবীগণের এহেন দায়িত্বশীল আচরণের কারণে জনগণের মধ্যে এই মর্মে আস্থা আসা শুরু হয়েছে যে, একমাত্র আইন সঙ্গত প্রক্রিয়াতেই আইনি প্রতিকার পাওয়া সম্ভব।
বারে এমন কিছু সিনিয়র আইনজীবী আছেন যাঁরা বলতে গেলে পুরো চট্টগ্রামেরই মুরুব্বি। বার ও বেঞ্চের মধ্যে বর্তমানে যে সুসম্পর্ক রয়েছে এতে তাঁদের ভূমিকা মুখ্য। নবীন আইনজীবীদের উদ্যম এবং প্রবীণদের অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে একটি চমৎকার হিউম্যান এনবাইরনমেন্ট তারা উপহার দিয়েছেন। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত হয়ত তাঁদের সম্পর্কে বলেছেনঃ
ধন্য জীবন তাহারি- যে জন নিজে বিচারিয়া
নিজের তরে
নীতি ও নিয়ম করি প্রণয়ন, আমরা তাহা
পালন করি ।
অনেক আইনজীবী আছেন যাঁরা মানবাধিকার, অসহায় নারীদের অধিকার এবং বঞ্চিত শিশুদের অধিকার রক্ষায় অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন। তাঁদের অনেকের মহৎ কর্ম প্রচেষ্টায় সামান্য সময়ের অংশগ্রহণ হৃদয়কে আলোড়িত করেঃ
স্বার্থ শূন্য হয় যদি এ দ্বাদশ দান,
স্বর্গের দেবতা নহে দাতার সমান।
আমাদের কলিগদের আলাপচারিতায় বারের প্রসঙ্গ উঠে আসলে সবাই এক বাক্যে স্বীকার করেন চিটাগাং বার বাংলাদেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও সুসভ্য। এমন বারটি কোথায় খুঁজে পাবে নাকো তুমি।

গণতন্ত্র: ভাই বল বন্ধু বল তোমায় ভালোবাসি
মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেসিতে বিচারক হিসেবে জয়েন করার পর এই পর্যন্ত বারের তিনটি নির্বাচিত কমিটি দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। দুইটি নির্বাচনও প্রত্যক্ষ করেছি। চমৎকার সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে চলেছে নির্বাচন প্রচারণা। সবগুলো কমিটির প্রেসিডেন্ট- সেক্রেটারীকে বেঞ্চের প্রতি অসম্ভব শ্রদ্ধাশীল মনে হয়েছে। বিচার কার্যক্রমের জন্য সহায়ক ও স্বস্তি-দায়ক অনুকূল পরিবেশের জন্য যা অত্যন্ত জরুরী। প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারি যেহেতু টপ লিডারশীপে অবস্থান করেন সেহেতু তাঁদের এপ্রোচ ও এটিচুড থেকে পুরো কমিটি তথা বারের স্বরূপ উপলব্ধি করা যায়। বর্তমান প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারিকে বলা যায় মানিক জোড়। ছোট বড় সব কাজেই তাঁদের দু’জনকে একত্রে দেখা যায়। নানা রকম অনুষ্ঠান- মিটিং-বারের উন্নয়ন মূলক কর্মকাণ্ডের তদারকি- এমনকি বিভিন্ন ছোটখাট দাওয়াতে এই দু’জন হ্যান্ডসাম স্মার্ট মানুষকে সবসময় পাশাপাশি পাওয়া যায়।
যতদূর জানি দুইজন দুই ভিন্ন প্যানেল থেকে নির্বাচিত। অথচ তাঁদের যুগল পথ চলাতে অনেক কিছু শিক্ষণীয় আমাদের এই অনিশ্চয়তাভরা নবীন গণতান্ত্রিক দেশে । হোয়াট এ লিডারশীপ! ভাই বল বন্ধু বল তোমায় ভালোবাসি …. সকাল বিকাল তোমার কাছে তা-ই-তো ছুটে আসি । প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও গানের এই কলি যারপরনাই প্রাসঙ্গিক ।

চুয়েলসা ও হাণ্ডি -কড়াইয়ের আড্ডা
ভালোবাসা ছাড়া কোন কিছুই আমাকে পরাস্ত করতে পারে না। চুয়েলসার ভালোবাসার কাছে পরাজিত হয়েছি। আমার মনের গহিনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ আর হৃদয় জুড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কথার কথা নয়। কাউকে খুশি করার জন্য নয়। সত্যিকার অর্থে যা মনে এসেছিল তাই বলেছি চুয়েলসা কর্তৃক আয়োজিত ইফতার পার্টিতে । প্রাণবন্ত ও আন্তরিক চুয়েলসা পরিবারের সদস্যরা। ভালোবাসায় ভরপুর এই মানুষগুলো। এই নবীন এবং সুন্দর মনের মানুষগুলো চট্টগ্রামের আইন অঙ্গনে অর্থবহ ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। আশাকরি ভ্রাতৃত্ব ও মহত্বের দিকে তাঁদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবেঃ
ভালোবাসা তবে কী-?
যার ভালোতে বসবাস তোর
চর্যা নিপুন ধী।

রক্তদান এবং আরো
রমজানের সময় ইফতার করেছি আইনজীবীদের সাথে । যথার্থই আন্তরিকতা মিশ্রিত সেই আয়োজনে অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষগুলো ও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অংশগ্রহণ করেছে। বড়ই প্রশান্তি-দায়ক সেই মিলন-মেলা। ঈদ-এ- মিলাদুন্নবী (সঃ) ও এর ব্যতিক্রম নয়। হিন্দু ধর্মীয় উৎসব গুলো আইনজীবীরা উৎসাহের সাথে পালন করেন। চট্টগ্রামের মানুষ সত্যিকার অর্থেই ধার্মিক তা সে ধর্মেরই অনুসারী হোন না কেন। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান আয়োজনে আইন চর্চাকারী এই মানুষগুলোর আগ্রহ ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টা প্রশংসার দাবী রাখে। বিজয়ার রক্তদান কর্মসূচী যেন ঘোষণা করছে মানুষ মানুষের জন্য। খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ ধর্মীয় উৎসবগুলো পালন হয় কিনা জানি না। না হয়ে থাকলে এটা একটা শূন্যতা।

অনেক পেয়েছি কিন্তু কিছুই দেয়া হয়নি
ফ্যাক্টের চুলচেরা বিশ্লেষণ এবং আইনের ক্রিটিক্যাল এনালাইসিস -এ এই বারের আইনজীবীরা যথেষ্ট দক্ষ ও যত্নশীল। ফলে সিদ্ধান্ত প্রদানে বিচারকদের কাজটা সহজতর হয়ে যায়। এটা আইনজীবীদের ইন জেনারেল পারফরমেন্স। সাথে যোগ হয়েছে অসাধারণ প্রতিভাধর কিছু আইনজীবীর প্রজ্ঞা ও ধীশক্তি, যা এই আইনঅঙ্গনকে নিয়ে গেছে অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন অবস্থানে । যখনি কোন জটিল আইনগত বিষয়ে পরামর্শ চেয়েছি, তখনি নিজেদের শত ব্যস্ততা পিছনে ফেলে পরম মমতা – আন্তরিকতা – ভালোবাসা এবং যুগপৎ শ্রদ্ধা নিয়ে এগিয়ে এসেছেন প্রবীণ অভিজ্ঞ আইনজীবীরাঃ
যা পেয়েছি সেই মোর অক্ষয় ধন
যা পাইনে বড়ো সেই নয়।
চিত্ত ভরিয়া রবে ক্ষণিক মিলন,
চির বিচ্ছেদ করি জয়।
আইনজীবীদের এই সর্বাত্মক সহযোগিতার বিনিময়ে হয়ত কিছুই দিতে পারিনি ।
উপমহাদেশের অন্যান্য বারগুলোর মধ্যে গ্রহণযোগ্য মাপকাঠির আলোকে তুলনা করলে এই বার শীর্ষ পর্যায়ে অবস্থান করবে এতে কোন সন্দেহ নেই।

বিদায় লাল দালান এবং ইতিহাসের পরিসমাপ্তি
গত বছর নতুন আদালত ভবন উদ্বোধন হয়। অন্যান্য আদালতের মত আমাদের সি.এম. এম. কোর্টও নতুন ভবনে চলে আসে। পুরাতন ভবনটির দিকে ফিরে তাকালে মনটা হাহাকার করে উঠে-যেন বিস্তৃত ঋদ্ধ এক ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। দালানটির নির্মাণ কৌশল ও স্থাপত্য শৈলীর পরতে পরতে ব্রিটিশদের রুচিশীলতা ও দূরদর্শিতা ফুটে উঠে। মাঝে মাঝে মজা করে বলতাম আমেরিকার হোয়াইট হাউজ চট্টগ্রামের রেড হাউজ ! পুরু দেয়াল- উঁচু ছাদ- সেই এক অন্যরকম আভিজাত্য! শীত- গ্রীষ্ম সব ঋতুতে আরামদায়ক। আত্মঘাতী বাঙালী খ্যাত নীরোদ সি. চৌধুরী ব্রিটিশদের কেন এত প্রশংসা করতেন-তার কিছু যৌক্তিকতা অনুমান করা যায়।
নতুন ভবনে এসেছি। খুব চাকচিক্যময় আধুনিক ভবন। যে কেউ মুগ্ধ হয়। তবে অফিসারদের চলাফেরার আলাদা প্যাসেজ না থাকায় নিরাপত্তা ঝুঁকি রয়েছে । এছাড়া এত বড় আদালত ভবনে আইনজীবীদের জন্য কোন মিলনায়তন রাখা হয়নি। এটা একটা বড় ধরণের ত্রুটি।

শব্দ বর্জন, মহাত্মা গান্ধী এবং যদি কিছু মনে না করেন
মহাত্মা গান্ধী পেশাগত জীবনে ছিলেন ব্যারিস্টার । দক্ষিণ আফ্রিকাতে কিছুদিন এই পেশাতে নিয়োজিতও ছিলেন।
ভারতীয়দের বাপুজি হওয়ায় আইনজীবী হিসেবে তাঁর সফলতা- ব্যর্থতা আলোচনার অনেক ঊর্ধ্বে চলে গেছে। এক সাংবাদিক কোন এক সময় তাঁকে প্রশ্ন করেন, ‘ছোটবেলায় আপনাকে কোন শিক্ষক কি পিটুনি দিয়েছিলেন?’ তাঁর কাছ থেকে হ্যাঁ- সূচক জবাব পেয়ে সাংবাদিক পুনরায় জিগ্যেস করেন ,‘দয়া করে তাঁর নামটি বলবেন?’ উত্তরে তিনি মজা করে বলেন, ‘তাঁর নাম বলে তাঁকে বিখ্যাত করতে চাই না। ’ বাপুজি স্বার্থপর ছিলেন না। স্বীয় শিক্ষাগুরুকে তিনি আলোচনা সমালোচনার বাইরে রাখতে চেয়েছিলেন। অকপটে বলছি- আমি সেরকম বড় মানুষ নই, আমার উদ্দেশ্যও তত মহৎ নয়। এই ধরণের লেখায় হয়ত অনেকের নামে উল্লেখ করা উচিত ছিল । বিভিন্ন যুক্তিসঙ্গত দিক বিবেচনা করে বিতর্ক এড়ানোর স্বার্থে তাঁদের নাম উল্লেখ করা হয়নি। তবে তাঁদের নাম অনেকের হৃদয়ে প্রোথিত হয়ে গেছে। তাঁরাও হয়ত বুঝতে পারবেন। চাণক্য পণ্ডিত ঠিকই বলেছেন:
অকথিত অভিপ্রায় বিজ্ঞে বুঝে লয়,
পরের ইঙ্গিত ধরা যায় বুদ্ধি বলে।
চট্টগ্রামে একটি কথা প্রায়শ শুনা যেত, ‘সাব আজিয়া ন বইয়ে’ (সাহেব আজ বসেননি) । অনেক পরে বুঝেছি এই কথাটা বিচার বিভাগ পৃথিকীকরণের পূর্বে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টগুলো সম্পর্কে বলা হতো। সাধারণ মানুষ আদালত অবমাননা বুঝেন না। হয়ত স্বভাবজাত ভদ্রতার কারণে কোর্ট বসেনি না বলে অফিসারের ব্যস্ততাময় অপারগতার দিকে সুশীল ইঙ্গিত করতেন। এই ছোট বিষয়টিতে যথাযথ শব্দ প্রয়োগের গুরুত্ব ফুটে উঠে। সম্মানিত, বিজ্ঞ, মহোদয় – এই শব্দগুলো বিভিন্ন শব্দের আগে পরে লেখা উচিত ছিল। কিন্তু কোন কোন সময় এই শব্দগুলোর পুনঃ পুনঃ উল্লেখ অতি আনুষ্ঠানিকতা বলে মনে হয়। ব্যারিস্টার মহাত্মা গান্ধী কিংবা জনাব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অথবা মিস্টার শেক্সপিয়ার বললে যেরূপ বেখাপ্পা লাগে! সাহিত্যে ভাষার গতিময়তা রক্ষার্থে এই ত্রুটি মার্জনীয় । সবিনয়ে বলছি- ক্ষমা চাই।

পুনশ্চ
এই শহরে জন্ম আমার। এই শহরের আলো বাতাসে বেড়ে উঠা। এই শহরের প্রতিটি ধূলিকণা আমায় কাছে টানে। এই শহর আমার সবচেয়ে প্রিয়। তার চেয়ে প্রিয় এই শহরের মানুষগুলো। বিচারক বলেই আমি আজ নিজ ভূমে পরবাসী। এই সীমাবদ্ধতার মধ্যে আইন অঙ্গনের হৃদয়বান মানুষগুলোর স্নেহ মাখা যে চমৎকার রূপ দেখেছি তাতে আনন্দে আপ্লুত হয়েছি। হয়েছি ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী। আলোকিত মানুষগুলোর জ্ঞানের দ্যুতি হৃদয়কে করেছে আলোকিত।
আলো তাঁর পদচিহ্ন
আকাশে না রাখে,
চলে যেতে জানে, তাই
চিরদিন থাকে।

লেখক: চীফ জুড়িশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, বান্দরবান

এই আর্টিকেলটি লেখক চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে লিখেছেন। যা ২০১০ এর ১০ ফেব্রুয়ারি দৈনিক পূর্বকোণ ও বারের ম্যাগাজিনে একসাথে প্রকাশ হয়

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।