শত-সহস্র ধনী গরিব এককাতারে ইফতার করেন আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদে

কেউবা সারিবদ্ধ হয়ে আবার কেউবা গোল হয়ে বসে আছেন। সবার সামনে রাখা আছে নানান পদের খাবারে সজ্জিত ইফতারি। একদল সেচ্ছাসেবক এগিয়ে দিচ্ছেন ইফতারির ছোট প্লেট-বড় প্লেট। কয়েকজন হরেক রকমের মগে শরিবত ও পানি এগিয়ে দিচ্ছেন। তাদের কেউ কেউ একে অপরের পরিচিত আবার অনেকে অপরিচিত। ধনী গরিব সব বিবেধ ভুলে সবাই সমবেত হয়েছেন সারাদিন রোজা রেখে একসাথে ইফতার করতে। বলছিলাম চট্টগ্রামের নগরীর আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদে একসাথে হাজার মানুষের ইফতারের মহাযজ্ঞের কথা।

বুধবার (২৯ মার্চ) সরজমিনে দেখা গেছে, আসরের নামাজের পর থেকে মসজিদের দিকে ছুটে আসেন রোজাদাররা। আসরের নামাজ পড়ে কেউ কেউ ব্যস্ত থাকেন কুরআন তিলাওয়াতে আবার কেউ কেউ বসে বসে দুরুদ পাঠ করেন। এর পর বিকেল ৫টার দিকে শুরু হয় ইফতারের প্রস্তুতি। ছাত্র থেকে শুরু করে অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী, সমাজের অনেক প্রতিষ্ঠিত মানুষের পাশে ভিক্ষুক, রিকশাওয়ালা, হকারসহ নানা বয়সীরা একসাথে বসে পড়েন আর সেচ্ছাসেবকরা শুরু করেন ইফতারি বিতরণ।

জানা গেছে, ২০০১ সাল থেকেই এভাবেই ইফতারের আয়োজন শুরু হয় মসজিদটিতে। ২০০৮ সাল থেকে শুরু হয় বড় আকারে মক্কা-মদিনার আদলে গণ-ইফতার। এখন রোজার শুরুর দিকে দুই থেকে আড়াই হাজার মানুষ এখানে নিয়মিত ইফতার করেন। রমজানের শেষ দিকে সেই সংখ্যা চার হাজারে পৌঁছায়। এখানে ইফতারসামগ্রীর মধ্যে থাকে ছোলা, মুড়ি, খেঁজুর, শরবত, জিলাপি, আলুর চপ, ছমুছা, অন্থন, পেঁয়াজু ইত্যাদি। সকাল থেকে এসব তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করেন বাবুর্চিরা।

মসজিদের খতিবের সহকারী হাছান মুরাদ জানান, রোজা শুরু প্রথম কয়েকদিন মানুষ কম হলেও রোজা বাড়ার সাথে সাথে মানুষ বেৃদ্ধি পায়। এখানে সম্পূর্ণ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় তৈরি করা হয় ইফতারি। টাটকা ও স্বাস্থ্যসম্মত ইফতারি যাতে সবাই খেতে পারেন সেই চেষ্টা করা হয়। মূলত আমাদের এই আয়োজনে অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তি সহায়তা করেন। তবে তারা তারা নাম প্রকাশ করেন না। সবাই সওয়াবের উদ্দেশে ইফতার আয়োজনে শরিক হন।

এদিকে মসজিদে ইফতার করতে আসা শামীম হোসেন নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এখানকার বিরাট পরিসরে ইফতারের আয়োজনের কথা আমি জানি। তবে কোনদিন আসা হয়নি। আজকে বাসার আমরা সবাই একসাথে এসেছি। একসাথের এত মানুষের সাথে ইফতার করা সত্যি খুবই মুগ্ধকর। অনেক ভালো লেগেছে।

এদিকে রফিক উদ্দীন নামে এক রিকশাচালক বলেন, রোজা রেখে রিকশা চালানো অনেক কঠিন। তবুও আমি চাই রোজা রাখতে। আর বিগত ৩ বছর ধরে রোজা আসলে আমি এখানে ইফতার করি, অনেক ভালো লাগে।

এদিকে নাছির উদ্দীন নামে এক চাকুরিজীবী বলেন, এভাবে এত মানুষের সাথে ইফতার সম্পৃতি ও সৌহার্দ বাড়ায় । মানুষে মানুষে ভালোবাসা বাড়ায়। এ আয়োজন সত্যি প্রশংসনীয়।

প্রসঙ্গত, আন্দরকিল্লা শাহী মসজিদ চট্টগ্রামসহ তার আশপাশের মানুষের আবেগ, অনুভূতি ও ভালোবাসার মসজিদে রূপ নেয়। বিশেষ করে জুমআর নামাজ পড়তে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এ মসজিদে নামাজ আদায় করতে মুসল্লিরা উপস্থিত হন। আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের স্থাপত্য ও গঠন মোগল রীতি অনুযায়ী তৈরি। সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৩০ ফুট উপরে ছোট্ট পাহাড়ের ওপর মসজিদটির অবস্থান।

চট্টগ্রামে মুসলিম বিজয়ের স্মারকস্বরূপ কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদটি। এ মসজিদের মূল ভবনের প্রবেশপথে কালো পাথরের খোদাই করে সাদা অক্ষরে ফার্সি ভাষায় যা লেখা রয়েছে, তা বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায়- ‘হে জ্ঞানী! তুমি জগৎবাসীকে বলে দাও, আজ এ দুনিয়ায় ২য় কাবা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’ যার প্রতিষ্ঠাকাল ১০৭৮ হিজরি। এখানেই খোদাই করা রয়েছে তার প্রতিষ্ঠার নামও।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।