করোনায় পার্কভিউর অবদান মনে রাখবে চট্টগ্রাম

স্বাস্থ্য সেবায় চট্টগ্রামবাসীর আস্থা অর্জনে এগিয়ে পার্কভিউ হসপিটাল

‘পৃথিবী একদিন করোনামুক্ত হবে, কিন্তু অদৃশ্য এই শত্রু চিনিয়ে দিলো— কে আপন, আর কে পর!’ পরিবারে বয়োবৃদ্ধ পুরুষের যখন শুধু কাশি হলো তখন করোনা সন্দেহে একটি কক্ষে তাকে আবদ্ধ করে বাইর থেকে দরজা বন্ধ করেছিল তার স্ত্রী-সন্তানরা। একটু পানি চেয়েও পাননি সেই বৃদ্ধ। পরদিন থানা পুলিশ এসে বৃদ্ধের লাশ উদ্ধার করে দাফনের ব্যবস্থা করেছিল।

করোনা মারা গিয়েছিল বলে এলাকায় লাশ দাফন করতে না দেওয়ার হৃদয় বিদারক দৃশ্যও দেখেছে মানুষ। করোনাকালে প্রসূতি স্ত্রীকে হাসপাতালের বারান্দায় রেখে মুঠোফোন বন্ধ করে স্বামী উধাও হওয়া, বৃদ্ধা মাকে রাস্তার ধারে রেখে সন্তান উধাও হওয়ার মতো ঘটনাগুলো মানুষকে শুধু কাঁদিয়েছে।

২০১৯ সালের শেষ দিকে চীনে এবং ২০২০ সালের মার্চে বাংলাদেশে করোনা শনাক্ত হয়। একই বছরের ৩ এপ্রিল চট্টগ্রামে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এরপর ৯ এপ্রিল করোনায় আক্রান্ত হয়ে চট্টগ্রামে প্রথম কোনো ব্যক্তি মারা যান।

করোনা সংক্রমনের শুরুতে সবাই ছিলেন অন্ধকারে। এর চিকিৎসা বা প্রতিরোধের ছিল না কোন সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন। চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে একে একে প্রাণ হারান প্রথিতযশা চিকিৎসকের পাশাপাশি নবীন চিকিৎসকও।

পরিস্থিতি ছিল এমন, করোনা সন্দেহে সরকারি হাসাতালের গেইটেও অবহেলায় মারা গেছেন প্রসূতি। দুনিয়ার আলো দেখার আগে মায়ের সাথে পরপারে পাড়ি জমান অনাগত সন্তানও। অবহেলিত চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালকে সরকার করোনা চিকিৎসায় বিশেষায়িতভাবে গড়ে তুললো। বেসরকারি পর্যায়ে চট্টগ্রাম মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতাল এগিয়ে এলো করোনা চিকিৎসায়।

আর প্রাইভেট হাসপাতালের মধ্যে শুরু থেকেই করোনা চিকিৎসায় এগিয়ে আসে পার্কভিউ হসপিটাল। শুধু এগিয়ে আসছে বললে কমই বলা হবে। বলা চলে— জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পার্কভিউ হাসপাতাল করোনা চিকিৎসায় নেতৃত্বও দিলো। রাত কিংবা দিন, হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এটিএম রেজাউল করিম তার দক্ষ, অভিজ্ঞ চিকিৎসক দল নিয়ে থেকেছেন চট্টগ্রামের মানুষের পাশে।

করোনায় পার্কভিউর অবদান মনে রাখবে চট্টগ্রাম 1
হসপিটালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হওয়ার দুই বছর পরও এই ছবি স্মৃতি হিসেবে সংরক্ষণে রেখেছেন রোগীর স্বজনরা

যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মরহুম মো. আফলাতুনের স্ত্রী আয়েশা বেগম ছিলেন করোনা আক্রান্ত। তিনি বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। এক মধ্য রাতে অক্সিজেন মাত্রা কমতির দিকে ছিল। পরিবারের সদস্যরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন । তাৎক্ষণিক পরিচিত সব হসপিটালে যোগাযোগ করলেন। করোনা পজিটিভ শুনে কেউ ভর্তি নিতে রাজি হলো না। অগত্য আয়েশা বেগমকে সাথে নিয়েই তাঁর সন্তানরা ছুটলেন পার্কভিউতে।

পার্কভিউতে প্রথমে ফ্লু কর্ণার। তারপর সিট মিললো কেবিনে। কেবিনে চিকিৎসা নিয়ে আয়েশা বেগম ফিরবেন নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটির বাসায়। তখন কেবিনে আসলো হসপিটাল ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পক্ষ থেকে ‘ফলের ঝুড়ি’। বিষয়টিকে মানবিকতার পাশাপাশি মানসিক শক্তি হিসেবে ব্যাখ্যা দিয়ে কৃতজ্ঞতা জানালেন আয়েশা বেগম ও তার পরিবারের সদস্যরা। তারা হসপিটালের জিএম তালুকদার জিয়াউর রহমান শরীফসহ পার্কভিউ হসপিটালের ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পৃক্ত সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।

চট্টগ্রামের হাতেম তাই খ্যাত চাঁনমিয়া সওদাগরের নাতি আশরাফুল ইসলাম চট্টগ্রাম খবরকে বলেন- ‘মে ২০২০, করোনার প্রকোপ তখন বাড়ছেই। আমি স্ত্রীসহ করোনা আক্রান্ত। আগের ঘনিষ্ঠজনদের সবার আচরণ বদলে গেলো। কেউ তাদের হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে রাজি হলেন না। ছেলের বন্ধুকে দিয়ে পার্কভিউতে যোগাযোগ করালাম। ডা. রেজাউল করিম একটাই কথা বলেলেন— “আমার হসপিটালে পাঠিয়ে দিন”। ওতটুকুতেই পার্কভিউতে যাওয়া। করোনামুক্ত হয়ে যখন ঘরে ফিরছি তখন মনে হলো দ্বিতীয় জীবন পেয়েছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘বছর ঘুরতেই আমার অতিশিপর চাচীও করোনা আক্রান্ত হলেন। বয়স্ক মানুষ বলে আমরাও চিন্তিত। তখনও একই অবস্থা, কেউ চিকিৎসা দিতে রাজি হলেন না। সেই পার্কভিউ, ডা. রেজাউল করিমই আমাদের পাশে থাকলেন। সপ্তাহ খানেক পর চাচীও সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরলেন।’

পার্কভিউতে করোনা চিকিৎসা নেওয়া রোগীদের তালিকায় আছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি, তৎকালীন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন, তৎকালীন জেলা সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি, উচ্চপদস্থ সরকারি আমলা, একাধিক মন্ত্রী-সাংসদের স্বজন। এছাড়াও আছেন অন্য হাসপাতালের মালিকপক্ষের পাশাপাশি চিকিৎসকও। বাদ যাননি পত্রিকার প্রকাশক থেকে সম্পাদকও।

করোনাকালে শুধু করোনা চিকিৎসা নয়, অন্য সকল সেবা উন্মুক্ত রেখেছিল পার্কভিউ কর্তৃপক্ষ। কক্সবাজারের সব হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে ব্যর্থ হয়ে মিলন কর্মকার এলেন চট্টগ্রাম শহরে। আত্মীয়-স্বজন সবার দ্বারস্থ হয়ে সবার পরিচিতজনদের দিয়ে যোগাযোগ করেও পাইলসের অপারেশন করাতে পারছিলেন না কোথাও। এদিকে তার রক্তক্ষরণে অবস্থা খারাপের পথে।

তার শ্যালক সন্তোষ শীল বলেন, ‘আমরা পার্কভিউ হসপিটালের এমডি ডা. এটিএম রেজাউল করিমকে বিষয়টি জানাই। তিনি শুধু বললেন, আমার চিকিৎসকরা আমার সম্পদ। তবুও ঝুঁকি নিতে হবে। কারণ রোগী আমার আমানত। আমার দুলা ভাইয়ের অপারেশ হলো, তিনি এখন সুস্থ আছেন। করোনার সেই কঠিন সময়ে আমাদের ঝুঁকিপূর্ণ চিকিৎসা সেবা নিয়ে পাশে ছিল পার্কভিউ। আমরা আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো।’

কোন মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে এমন মহামারিতেও আপনারা চিকিৎসা সেবা উন্মুক্ত রেখেছিলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে পার্কভিউ হসপিটালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এটিএম রেজাউল করিম বলেন, ‘মন্ত্র একটাই, চিকিৎসক হিসেবে দেশ ও জাতির প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা রয়েছে। সেই দায়বদ্ধতা থেকেই করোনাকালে আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারিনি। আমরা আমাদের সামর্থ্যের সবটুকু নিয়ে চেষ্টা করেছি, প্রথমে ১২টি পরে আরও ১২টিসহ ২৪টি আইসিইউ বেড করোনা চিকিৎসায় যুক্ত করেছি। শুরু থেকেই নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় অক্সিজেন সরবরাহ নিরবিচ্ছিন্ন রেখেছি আমরা।’

ছাড়াও ফেব্রুয়ারিতে সেবা পক্ষ ঘোষণা দিয়ে প্রায় স্বল্প খরচে ১৫ হাজার রোগীকে চিকিৎসা সেবা দিয়েছে পার্কভিউ হসপিটাল। আগামী কিডনি দিবসে বিশেষায়িত চিকিৎসারও আয়োজন করছেন বলে জানান পার্কভিউর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এটিএম রেজাউল করিম।

আকিজ

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।