খরা কেটেছে বান্দরবানে, ব্যবসায়ী-পর্যটকদের হাসিমুখ

পাহাড় সৌন্দর্যের এক অমেয় উৎস। যেখানে গেলে প্রশান্তি মিলে, সুযোগ হয় প্রাণভরে নিশ্বাস নেওয়ার। তবে সম্প্রতি দেশের পাহাড়গুলোতে পড়েছে কালো ছায়া। এসব পাহাড় ব্যবহার করা হচ্ছে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। তাদের মধ্যে বান্দরবানে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) আস্তানার সন্ধান মেলায় পাহাড়কে নিরাপদ করতে শুরু হয় অভিযান। যার কারণে পর্যটকদের নিরাপত্তায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে। তবে চলমান বড়দিন ও সাপ্তাহিক ছুটিতে প্রাণ ফিরেছে বান্দরবানে। দীর্ঘদিন পর খরা কেটেছে ব্যবসায়ীদের, হাসি ফুটেছে পর্যটকদের মুখেও।

বান্দরবানের নীলাচল, মেঘলা, চিম্বুক, নীলগিরি, নীল দিগন্ত, তমাতুঙ্গী, ডিম পাহাড়, শৈলপ্রপাত, প্রান্তিক লেক, তিন্দু, স্বর্ণ মন্দিরসহ রয়েছে বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান। যেখানে প্রতিবছর শীতের শুরুতে বাড়ে পর্যটকদের আগমন। পাহাড়ি কন্যা খ্যাত এই অঞ্চল নভেম্বর-ডিসেম্বরে ভরে যায় দর্শনার্থীদের পদভারে। তবে এ বছরের চিত্রটা ছিলো কিছুটা ভিন্ন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কারণে গত অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে বান্দরবানে জারি করা হয় ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা। এতে করে মুখ থুবড়ে পড়ে ওই অঞ্চলের পর্যটন খাত। করোনার ধকল কাটিয়ে যখন ব্যবসায়ীরা পিঠের মেরুদণ্ড সোজা করার চেষ্টা করছিলো ঠিক তখনি নতুন ঝড় নেমে আসে তাদের ওপর।

তবে খুশির সংবাদ হলো সাপ্তাহিক ছুটি এবং বড়দিন ব্যবসায়ীদের সুদিন ফিরিয়েছে। ডিসেম্বরের প্রথম দিকে রুমা এবং রোয়াংছড়ি উপজেলা ছাড়া বাকি স্থানগুলো ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়া হয়। আর চলমান ছুটিতে কানায় কানায় ভরে উঠেছে পর্যটনকেন্দ্রগুলো। যা পর্যটকদের সুযোগ করে দিয়েছে পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগের তেমনি ব্যবসায়ী ও কর্মজীবীদের খরা কেটেছে।

রোববার (২৬ ডিসেম্বর) সরজমিনে দেখা গেছে, যান্ত্রিক জীবনের ব্যস্ততা ভুলে কোলাহল মুক্ত পরিবেশে পরিবার পরিজন, বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে পর্যটকরা চাঁদের গাড়িতে করে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে। জেলার মেঘলা নীলাচল প্রান্তিক লেক, শৈলপ্রপাত, চিম্বুক, নীলগিরি, নীল দিগন্ত ,রেমাক্রি, নাফাখুম, তমাতুঙ্গীসহ সবগুলো দর্শনীয় স্থান এখন ভ্রমণ পিপাসুদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে। কেউ বা ছুটে যাচ্ছে ঝর্ণার সৌন্দর্য দেখতে, আবার কেউবা ছুটে যাচ্ছেন সুউচ্চ পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখতে। কেউ এসেছেন বাচ্চাদের নিয়ে ডিসেম্বরের অবকাশ যাপনে কেউবা আবার এসেছেন সখ্যতা বাড়াতে। আবার তরুণ-তরুণীরাও থেমে নেই। বন্ধ স্কুল, বন্ধ কলেজ, তাড়া নেই বিশ্ববিদ্যিালয়ের। এই সুযোগে মনের মতো করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তারা।

খরা কেটেছে বান্দরবানে, ব্যবসায়ী-পর্যটকদের হাসিমুখ 1

এদিকে হোটেল-মোটেলেও চলছে ব্যস্ততা। খালি নেই হোটেলের কোন কক্ষ। একদল যাচ্ছে তো আরেক দল এসে পৌঁছাচ্ছে। তাছাড়া রোববার ছুটির শেষ হওয়ায় অনেকে আবার কক্সবাজার থেকে ফিরে এসেছেন বানন্দরবান ভ্রমণে।

বেড়াতে আসা দম্পতি ফারহানা-শুভ বলেন, পাহাড়ে চারদিকে সবুজের সমারোহ। কুয়াশায় ঢাকা পাহাড়ে সাদা মেঘের হাতছানি। চমৎকার একটা পরিবেশ বান্দরবানে। মুগ্ধ হবার মত সব সৌন্দর্য এ জেলায়। বিয়ের পর এই প্রথম আমরা একসাথে বের হলাম। সত্যি চমৎকার লাগছে।

পঞ্চম শ্রেণীর পরীক্ষা শেষ করা তুষি, ৮ বছর বয়সী কাব্য বান্দরবান বেড়াতে এসেছেন বাবা-মা এবং দাদা-দাদীরন চোখে। তারা বলেন, আমরা প্রথমে কক্সবাজর গিয়েছি। সেখান থেকে এখানে এসেছি। অনেক ভালো লাগতেছে। গত রাতে আমরা বারবিকিউ করেছি কয়েকজন ভােইয়া গান গেয়েছে। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো এখানে কেউ পড়তে বসার কথা বলছে না।

পর্যটক কাকন-রিমা-সাকিব-নিরু বলেন, আমরা একসাথে অনেক স্থান ভ্রমণ করেছি। পাহাড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আমরা সত্যিই মুগ্ধ। দার্জিলিং ভ্রমণে গেছি কয়েকবার। কিন্তু বান্দরবান না আসলে বুঝতেই পারতাম না, আমার দেশটা আরও কতটা সুন্দর। প্রকৃতির সঙ্গে শৈল্পিক ছোঁয়ায় সাজানো গোছানো বান্দরবানের মেঘলা, নীলাচল, চিম্বুক পাহাড়ের দর্শনীয় স্থানগুলোয় খুবই চমৎকার।

এদিকে পর্যটকদের আগমনে সুদিন এসেছে বান্দরবানের পর্যটন খাতের সাথে সংশ্লিষ্টদের। জানা গেছে, জেলায় পর্যটকদের সেবায় রয়েছে শতাধিক হোটেল-মোটেল-রিসোর্ট-গেস্ট হাউস। এছাড়া পর্যটক পরিবহনে রয়েছে ৪ শতাধিক চাঁদের গাড়ি, ২ শতাধিক নৌ-যান, সব মিলিয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জেলার ২৫ হাজার মানুষ পর্যটন ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্ট। এতদিন বেশ এসব স্থান খালি থাকায় ক্ষতির সম্মুখীন হলেও এখন পুষিয়ে নেওয়া চেষ্টা করছে ব্যবসায়ীরা।

হোটেল অরণ্য এর মালিক জসিম উদ্দীন বলেন, ডিসেম্বরে আমাদের পর্যটক মৌসুম শুরু হলেও প্রথম দিকে পর্যটকের তেমন সাড়া পাইনি। শুক্রবার থেকে যে টানা ছুটি ছিল সেটাতে আমাদের হোটেলে বুকিং হয়েছে। এতে আমরা ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবো।

খরা কেটেছে বান্দরবানে, ব্যবসায়ী-পর্যটকদের হাসিমুখ 2

হোটেল গার্ডেন সিটির স্বত্বাধিকারী মো. জাফর উল্লাহ বলেন, ১৬ ডিসেম্বরের পর থেকে পর্যটকের ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে, হোটেলে কোন সিট খালি নেই।

বান্দরবান হোটেল-মোটেল ওনার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি অমল কান্তি দাশ বলেন, টানা তিনদিন ছুটিতে পর্যটক আশানুরূপ হবে। পর্যটন ব্যবসায়ীরা কিছুটা হলেও ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন। আর পর্যটকদের জন্য শহর এলাকায় সন্ধ্যার সময়ে বিনোদনের জন্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।

বান্দরবানের সরকারি পর্যটন মোটেলের ব্যবস্থাপক আলো বিকাশ চাকমা বলেন, আগামী ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত শতভাগ রুম বুকিং করা আছে। তাই আগামী ২৪ ও ২৫ ডিসেম্বর দুইদিন বান্দরবান ভ্রমণপ্রত্যাশীদের হোটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে আবাসন নিশ্চিত করা উচিত।

বাড়তি পর্যটকদের কথা বিবেচনায় জোরদার করা হয়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থায়। এছাড়া কোথাও কোন অনিয়ম হচ্ছে কি না তা তদারকি করতে প্রতিনিয়ত চলছে জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান।

বান্দরবান ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত সুপার নকিবুল ইসলাম বলেন, টানা তিন দিনের ছুটিতে হাজার হাজার পর্যটকের সমাগম হতে পারে। তাই আমাদের একাধিকও টিমও কাজ করছে। পর্যটকদের নিরাপত্তায় আমরা সবসময়ই সজাগ আছি।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।