‘গৌরবের পঞ্চাশে, মিলি প্রাণের উচ্ছ্বাসে’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চব) জীববিজ্ঞান অনুষদের দিকে পা বাড়াতেই চোখ পড়ল একদল মধ্যবয়সী নরনারীর ওপর। খুব উৎসাহ উদ্দীপনায় মেতে আছেন তারা। আপাতদৃষ্টিতে তাদের দেখে মধ্যবয়সী লাগলেও তাদের কর্মকাণ্ড দেখে মনে হবে সদ্য অনার্সে ভর্তি হয়েছেন। বলছিলাম চবির প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবের কথা।

শুক্রবার ২০ (জানুয়ারি) ‘গৌরবের পঞ্চাশে, মিলি প্রাণের উচ্ছ্বাসে’— প্রতিপাদ্যে তিন পর্বের বর্ণিল আয়োজনে উদযাপিত হয়েছে এ উৎসব।

সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদ প্রাঙ্গণ থেকে প্রশাসনিক ভবন পর্যন্ত বর্ণাঢ্য র‍্যালির মাধ্যমে শুরু হয় বিভাগটির সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা।
এরপর জীববিজ্ঞান অনুষদের সামনে বেলুন উড়িয়ে উৎসবের শুভ উদ্বোধন করেন বিভাগটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক ড. শফিক হায়দার চৌধুরী (অব.)।

তিন পর্বের দিনব্যাপী এ উৎসবটি বিভাগের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের প্রাণের মিলনমেলায় রঙিন হয়ে উঠে। বিভাগের ১ম ব্যাচ থেকে শুরু করে শেষ ব্যাচ পর্যন্ত নানা বয়সের, নানা পেশার হাজার কয়েক বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থী এই উৎসবে অংশ নিয়েছেন।

কেউ এসেছেন পরিবারের সকল সদস্যকে নিয়ে। পরিবারের সদস্যদের অধির আগ্রহে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন পাঠ চুকিয়ে যাওয়া প্রিয় ক্যাম্পাসটাকে।

দীর্ঘদিন পর মায়া জড়ানো এই প্রাণের ক্যাম্পাসে নিজ বিভাগে আসতে পেরে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন অনেকেই। আবার অনেকে প্রিয় বন্ধুদের সান্নিধ্য পেয়ে হয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েন। কেউ স্মৃতিচারণ করেন পুরানো দিনের। কেউ বা ঘুরে আসেন ক্লাসরুম ও দীর্ঘদিন অবস্থান করা আবাসিক হলে। কেউ বা মেতে উঠেন সেলফি তোলার উৎসবে।

প্রায় ৩০ বছর পর নিজের বিভাগের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবে এসে ১৭তম ব্যাচের কাঞ্চনা চক্রবর্তী তার অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন, আজ অনেক দিন হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বেরিয়েছি৷ কিন্তু এই বিভাগ, এই বিশ্ববিদ্যালয় আমার মনে-প্রাণে রয়ে গেছে। আজ এই উৎসবে এসে প্রিয় বন্ধু-বান্ধবদের সাথে দেখা হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন আবারও সেই ছাত্রজীবনে ফিরে গেলাম।

বহুদিন পর ২৮তম ব্যাচের কামরুজ্জামান এসেছেন নিজ বিভাগে। তিনি বর্তমানে একটি সরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘ক্যাম্পাস ছাড়ার পর অনেকের সাথে আর দেখা হয়নি। দীর্ঘদিন পর সবাই মিলিত হয়েছি। অনুভূতি প্রকাশ করার মতো না। খুব ভালো লাগছে। সবাই মিলে মনমতো আড্ডা দিচ্ছি।

জীববিজ্ঞান অনুষদের সামনে ঝুপড়ি দোকানে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলেন রোকসানা আফরোজ লিজা। এমন সময় চট্টগ্রাম খবরকে তিনি বলেন, আজকের এই সুবর্ণজয়ন্তীতে আমরা সবাই খুবই উচ্ছ্বসিত, উল্লাসিত। খুব মজা করছি আমরা। আমরা চাই, এরকম আয়োজন বারবার হোক, এরকম দিন বারবার আসুক। আমাদের সেই পুরনো মুখগুলোর সাথে বারবার দেখা হোক।

‘গৌরবের পঞ্চাশে, মিলি প্রাণের উচ্ছ্বাসে’ 1

সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব উপলক্ষে এদিন জীববিজ্ঞান অনুষদ প্রাঙ্গণে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এতে সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়ার সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) অধ্যাপক বেনু কুমার দে।

বিশেষ অতিথি উপ-উপাচার্য বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী একটি বিভাগ হলো এই প্রাণীবিদ্যা বিভাগ। ইতোমধ্যেই বিভাগটি ৫০ বছর পূর্ণ করেছে। এই বিভাগ থেকেই বের হয়ে গেছেন দেশের বহু গুণীজন। আমি বিভাগের অ্যালামনাই বর্তমান ও সাবেকদের সবার প্রতি শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। এই প্রাণিবিদ্যা বিভাগ আরও অনেক দূর এগিয়ে যাবে।

অনুষ্ঠানে স্মারক বক্তব্য (অনলাইন) রাখেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. আশিষ কুমার পানিগ্রাহী। তিনি তার বক্তব্যে প্রাণিবিদ্যার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন।

তিনি বলেন, পৃথিবীতে যেভাবে প্রাণি ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, গাছপালা নষ্ট হচ্ছে, তাতে আমরা খুবই চিন্তিত। আমাদেরকে এসব ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে কাজ করে যেতে হবে। এরপর তিনি প্রাণিবিদ্যা বিভাগের পঞ্চাশ বছরের সকল শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনি তার বক্তব্য শেষ করেন।

সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া বলেন, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ চবির একটি ঐতিহ্যবাহী ও সমৃদ্ধশালী বিভাগ। গত ৫০ বছরে এই বিভাগ থেকে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। চবির এই ঐতিহ্যবাহী বিভাগের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে আজ বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে আমাদের এই প্রাণিবিদ্যা বিভাগ।

এসময় জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. তৌহিদ হোসেন, আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলী আজাদী (অব.), গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অবসরপ্রাপ্ত সচিব ড. অপরূপ চৌধুরী, সিনিয়র সচিব মো. হেলালুদ্দীন আহমদ প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিসহ মোট ৩১ জনকে সম্মাননা প্রদান করা হয় যারা বিভাগের শিক্ষা ও গবেষণায় এবং বিভাগের বাহিরে যারা রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে।

এরপর দুপুরের পর অনুষ্ঠানের তৃতীয় পর্বে বিভাগের সাবেক ও বর্তমান৷ শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিবেশনার আয়োজন করা হয়।

প্রসঙ্গত, অধ্যাপক ড. শফিক হায়দার চৌধুরীর হাত ধরে ১৯৭৩ সালের ১ জানুযারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের যাত্রা শুরু হয়। তিনিই ছিলেন এই বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। এই বিভাগে বর্তমানে কীটতত্ত্ব, ফিশারিজ অ্যান্ড লিমনোলজি, প্যারাসাইটোলজি ও ওয়াইল্ডলাইফ অ্যান্ড কনজারভেশন বায়োলজি শাখা চলমান রয়েছে।

বর্তমানে প্রাণিবিদ্যা বিভাগে ১৭ জন শিক্ষক কর্মরত আছেন। তাছাড়া অনার্সে ৪৪২ জন, মাস্টার্সে ৫৯ জন, এম.ফিল ১১ জন ও পিএইচডি’র ১০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এ পর্যন্ত বিভাগ থেকে অনার্সে ১ হাজার ৩০৩ জন, মাস্টার্সে ১ হাজার ৩৩৮ জন, এম.ফিল ১০ জন ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন ১৭ জন শিক্ষার্থী।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।