ঘূর্ণিঝড় আসলেই ঘুম ভাঙে পানি উন্নয়ন বোর্ডের, আতঙ্কে উপকূলবাসী

“এখন ৮ নম্বর সর্তকতা সংকেত চলছে। বাপ-দাদার ভিটা বাড়ি ফেলে আশ্রয় কেন্দ্রের দিকে যাচ্ছি আমরা। আর এ মুহুর্তে পানি উন্নয়নের বোর্ডের লোকেরা আসছে বেঁড়িবাঁধের কাজ করার জন্য।” আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার উপকূলীয় এলাকা রায়পুরের সৈয়দ মাঝির বাড়ির রেহানা আকতার (৬০) নামে এক বৃদ্ধা।

শনিবার (১৩ মে) সকাল থেকে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট গভীর নিম্নচাপটি আরও শক্তি সঞ্চয় করে প্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখায় রূপ নিয়েছে। রোববার নাগাদ এটি উপকূলে আঘাত হানার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে আনোয়ারা উপকূলের শঙ্খনদ, কর্ণফুলীর জুলধা ইউনিয়নের ডাঙারচর ও বঙ্গোপসাগরের কয়েক স্থানে ধসে যাওয়া বেড়িবাঁধ ঘূর্ণিঝড়ের ভয়কে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

জানা গেছে, দুর্যোগ মোকাবেলায় আনোয়ারার ৫৮টি আশ্রয় কেন্দ্র ও কর্ণফুলীতে ১৮টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এরমধ্যে আনোয়ারার রায়পুর ও কর্ণফুলীর জুলধায় টেকসই বেঁড়িবাধ এখনো নির্মিত হয়নি। ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় আতঙ্কে কাটে উপকূলে বসবাসরত মানুষদের জীবন।

উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের পূর্ব গহিরা বরফকল থেকে কোস্টগার্ড জেটি পর্যন্ত এবং জুঁইদী ইউনিয়নের ভোলার বাড়ি এলাকার বেড়িবাঁধের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। গত বছরের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় অশনির প্রভাবে স্বাভাবিকের চেয়ে জোয়ারের পানি বেড়ে গেলে এসব এলাকার বেড়িবাঁধ টপকে পানি ঢুকেছিল। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড জরুরি ভিত্তিক বালুর বস্তা ফেলে পানি ঠেকাতে লোকালয়ের তেমন ক্ষতি হয়নি।

অপরদিকে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের চলমান প্রতিরক্ষা কাজের মধ্যে প্রায় ৯০০ মিটার কাজ মাটির অভাবে থমকে রয়েছে। সাগরবেষ্টিত উপকূলের বার আউলিয়ায় ৩০০ মিটার, বাইগ্যার ঘাটে ৩০০ মিটার ও উঠান মাঝির ঘাট এলাকায় ৩০০ মিটার বাঁধের কাজ হয়নি।

তবে শনিবার (১৩ মে) সকালে উপকূলকে ঘূর্ণিঝড় মোখার আঘাত থেকে রক্ষা করতে তাড়াহুড়া করে কাজ শুরু করে চট্টগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ড। তাদের এসব কাজ দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন স্থানীয়রা।

স্থানীয়দের অভিযোগ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা আর ঠিকাদারের গাফিলতির কারণে যথাসময়ে বেড়িবাঁধ নির্মাণ হয়নি। যার কারণে ঘূর্ণিঝড় মাথায় নিয়ে ভয়ে থাকতে হয় তাদের। রায়পুর কোস্টগার্ড এলাকা ও গহিরা বাইন্যের ঘাট এলাকায় জিও ব্যাগ বসানোর কাজ করছে। এ কাজে নিয়োজিত রয়েছে ১০-১২ শ্রমিক। দেখাশুনা করছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড ও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। তাদের তড়িগড়ি কাজকে স্থানীয়রা তামাশা বলেও মন্তব্য করছেন।

স্থানীয় বাসিন্দা কায়সার উদ্দিন জানান, পূর্ব গহিরার বরফকল থেকে কোস্টগার্ড জেটি পর্যন্ত বেড়িবাঁধ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ঘূর্ণিঝড় উঠলে তড়িগড়ি করে ওই অংশে সংস্কার করা হয়। কিন্তু অদৃশ্য কারণে ওই স্থানে ৬ বছরেও স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ হয়নি। বর্তমানে বাঁধের যে উচ্চতা তাতে সামান্য জলোচ্ছ্বাসে তা উপচে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করবে।

কর্ণফুলীর জুলধা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাজী নুরুল হক চৌধুরী বলেন, বিভিন্ন শিল্প কারখানার মালিকরা সরকারী খাস জমি থেকে শুরু করে বেড়িবাঁধের জমি দখল করে রাখা কোনো মতেই সম্ভব হচ্ছে না বেঁড়িবাধ নির্মাণ।

কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মামুনুর রশিদ বলেন, কর্ণফুলীতে ১৮টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। যাতে পরিস্থিতি অনুযায়ী ঝূঁকিপূর্ণ লোকজন সেখানে আশ্রয় নিতে পারে। বেড়িবাঁধের ব্যপারে সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে এবং বেড়িবাঁধ নির্মাণ করার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. মিজানুর রহমান বলেন, শঙ্খ নদীর রায়পুর ইউনিয়নের প্রায় ৯০০ মিটার এবং গহিরা বাইগ্যার ঘাট এলাকার ভাঙনসহ বিভিন্ন অংশে পাথর বসানোর জন্য প্রকল্প পাঠানো হয়েছে। অনুমোদনের পর টেন্ডার প্রক্রিয়ায় পাথর বসানোর কাজ শুরু হবে। এখন জরুরী প্রয়োজনে ঝূঁকিপূর্ণ বাঁধ এলাকায় জিও ব্যাগ বসানো হচ্ছে। যাতে করে অতিরিক্ত ক্ষতিতে না পড়ে উপকূলবাসী।

এদিকে শনিবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত উপজেলা প্রশাসন ও রায়পুর ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে গাড়ি মাধ্যমে উপকূল এলাকার মানুষদের নিয়ে আসা হচ্ছে আশ্রয় কেন্দ্র। আগত মানুষদের শুকনো খাবারসহ বিভিন্ন খাদ্য বিতরণ করেন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমিন শরীফ। বিকালে রায়পুর উপকূলীয় এলাকা ও আশ্রয় কেন্দ্র গুলো পরির্দশনে করেছেন উপজেলা চেয়ারম্যান তৌহিদুল হক চৌধুরী ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইশতিয়াক ইমন, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. জসিম উদ্দিন।

আনোয়ারার ইউএনও মো. ইশতিয়াক ইমন বলেন, উপজেলার ৫৮টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বিভিন্ন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও সিপিপি টিম লিডারদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনীয় ত্রাণসামগ্রী, শিশুখাদ্য মজুদ রয়েছে। এ ব্যাপারে সব সময় মনিটরিং করা হচ্ছে। উপকূল এলাকায় মাইকিং ও উপকূলীয় এলাকা থেকে নিয়ে আসা হচ্ছে লোকজনদের।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।