ঘূর্ণিঝড় মোখা: আতঙ্কে উপকূলের মানুষ

বঙ্গোপসাগর ঘেঁষে কর্ণফুলীর নদীর উপকূলীয় উপজেলা জুলধা ইউনিয়নের ডাঙারচর এলাকায় ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকির মধ্যেই বসবাস প্রায় ৩০ হাজার মানুষের। নদীবেষ্টিত এই এলাকার মানুষ একটু বেশি ঝুঁকিতে থাকেন সব সময়। কারণ এই উপজেলার একটা বড় অংশ জুলধা ইউনিয়নের ডাঙারচর রয়েছে বেড়িবাঁধের বাইরে। যার ফলে ঘূর্ণিঝড় মোখার সময় যত ঘনিয়ে আসছে, মানুষের আতঙ্ক ততো বাড়ছে। এ এলাকা জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষার জন্য যেমন টেকসই বাঁধ নেই, তেমনি যাতায়াতের ব্যবস্থা উন্নত নয়। যার ফলে যেকোন দুর্যোগে এসব এলাকার মানুষের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়ে থাকে।

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ আতঙ্কে থাকলেও উপকূল এলাকার লোকজন আশ্রয় কেন্দ্রে তেমন আসছে না বলে জানিয়েছেন উপজেলা প্রশাসন। উপজেলা প্রশাসন জানিয়েছে, শনিবার সকাল থেকে উপজেলার ১৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খুলে দেওয়া হয়েছে। লোকজনকে আশ্রয় কেন্দ্রে আসার জন্য প্রচারণা চালানো হচ্ছে। তবে এখনও পর্যন্ত কোথাও কোনো বড়ধরণের ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। নদীতে জোয়ারের পানি বাড়তে শুরু করেছে এবং সকাল থেকে গুড়ি-গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে।

এরমধ্যে এলাকা থেকে সাইক্লোন শেল্টার দূরে হওয়ায় দুর্যোগের সময় গ্রামের অনেক লোক শহরের আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে চলে গেছেন। বেশির ভাগ মানুষই আশ্রয় কেন্দ্রে আসেনি। আর যারা রাতে এসেছেন তারাও রবিবার সকালে চলে গেছেন বলে জানা গেছে।

জুলধার ডাঙারচর এলাকার স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ের ৩২ বছর পেরিয়ে গেলেও দুর্গত ডাঙ্গারচরর নির্মাণ হয়নি পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার ও টেকসই বেঁড়িবাধ। এ দুর্যোগে উপজেলা প্রশাসনকে দেখা গেলেও শনিবার থেকে রবিবার সকাল পর্যন্ত স্থানীয় কোনো জনপ্রতিনিধি বা রাজনৈতিক দলের নেতাদের সহযোগিতা বা খোঁজ খবরও নেননি বলে আক্ষেপ করেন স্থানীয়রা। আর প্রতি বছর বর্ষার মৌসুম ও ঘূর্ণিঝড়ে এ এলাকার মানুষ ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখী হতে হয় বলেও অভিযোগ করেন।

১৯৯১ সালের ভয়াবহ সেই জলোচ্ছ্বাসে বিলীন হয়ে যায় এ জনপদের হাজার হাজার বাড়িঘর, পাশাপাশি মারা যায় শতাধিক নারী পুরুষ ও শিশু। এ দুঃখজনক স্মৃতি এখনো ভূলেনি তারা। আর টেকসই বেঁড়িবাধ ও পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টারের অভাবে এ অঞ্চলে প্রাণহানির সংখ্যা বেশি ঘটেছিল বলে দাবি স্থানীয়দের।

তবে বিভিন্ন দুর্যোগের পর ইউনিয়ন পরিষদ ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের প্রচারের মাধ্যমে এলাকার লোকেরা সচেতন হয়েছেন দুর্যোগ সম্পর্কে। ঘূর্ণিঝড় মোখা মোকাবেলায় প্রস্তুত রয়েছে কর্ণফুলী উপজেলা প্রশাসন। জরুরি প্রয়োজনে খোলা রয়েছে কন্ট্রোল রুম। উপকূলীয় এলাকা গুলোতে করা হচ্ছে মাইকিং ও পরিদর্শন করছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মামুনুর রশিদ ও উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) পিযুষ কুমার চৌধুরী।

কর্ণফুলী সিপিপি টিমলিডার আবদুল মাবুদ বাবুল জানান, কর্ণফুলীতে ৬২০জন সিপিপির সদস্য কাজ করছেন। যেকোনো মুহূর্তে মানুষের পাশে থাকার জন্য প্রস্তুত সিপিপির সদস্যরা।

স্থানীয় বাসিন্দা সাবেক ইউপি সদস্য ও যুবলীগ নেতা সিরাজুল ইসলাম হৃদয় জানান, এলাকা থেকে সাইক্লোন শেল্টার অনেক দূরে, তাই দুর্যোগের সময় গ্রামের অনেক লোক আশ্রয় নিতে শহরের আত্মীয় স্বজনদের বাসায় চলে যায়। এখনও পর্যন্ত আশ্রয় কেন্দ্রে তেমন মানুষ আসেনি। আর যারা আসছেন তারাও সকালে চলে গেছে।

কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মামুনুর রশিদ বলেন, ১৮টি আশ্রয় কেন্দ্র গুলোতে যারা আশ্রয় গ্রহণ করবেন তাদের খাদ্যসামগ্রী দেওয়া হবে। ঘূর্ণিঝড় পরবর্তীতেও উপজেলা প্রশাসনের জরুরী সেবাকেন্দ্র চালু থাকবে। ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় জরুরি তথ্যসংগ্রহ ও ত্রাণ বিতরণের জন্য সার্বক্ষণিক নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে। জরুরী প্রয়োজনে কন্ট্রোল রুমে যোগাযোগ করতে (০১৮৬৬-২৮৩৮১৫) বলা হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, গতকাল শনিবার রাতে ডাঙারচর আশ্রয় কেন্দ্রে কিছু মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলো, তারা সকালে আবার চলে গেছেন। তবে বিকেল থেকে আবারও আসতে শুরু করেছে। ১৮টি আশ্রয় কেন্দ্র ছাড়াও উপজেলার ২৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও আশ্রয় নিতে পারবেন মানুষ।

এদিকে আনোয়ারার উপজেলার চিত্র। এ উপজেলায় বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ মোকাবেলায় সবধরণের প্রস্তুতি নিয়েছে আনোয়ারা উপজেলা প্রশাসন। উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের ৫৮টি আশ্রয় কেন্দ্রর মুজিবকিল্লাসহ ৩৩টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রায় ৫ হাজারের অধিক মানুষ আশ্রয় নিয়েছে বলে জানিয়েছে প্রশাসন।

তাদের মধ্যে দেড় হাজার ৯০জন হচ্ছে পুরুষ, ২ হাজার ৬৯১জন হচ্ছে নারী ও শিশু রয়েছে ৯৩২জন এবং প্রতিবন্ধি রয়েছে ৬৭ জন। আশ্রয় নেওয়াদের মধ্যে শুকনো খাবারসহ বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করছেন প্রশাসনসহ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা।

নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়ার জন্য গত দু’দিন ধরে প্রশাসন, স্থানীয় চেয়ারম্যান, সিপিপি ও স্বেচ্ছাসেবকরা মাইকিংসহ বিভিন্ন প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছে। শনিবার সকাল থেকে উপজেলার আশ্রয়কেন্দ্র খুলে দেওয়া হয়েছে। লোকজনকে আশ্রয় কেন্দ্রে আসার জন্য প্রচারণা চালানো হচ্ছে। তবে এখনও পর্যন্ত কোথাও কোনো বড়ধরণের ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। নদীতে জোয়ারের পানি বাড়তে শুরু করেছে এবং সকাল থেকে গুড়ি-গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। এরমধ্যে এলাকা থেকে সাইক্লোন শেল্টার দূরে হওয়ায় দুর্যোগের সময় গ্রামের অনেক লোক আশ্রয় কেন্দ্রে না গিয়ে শহরের আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে চলে গেছেন বলে দাবী করেছেন আশ্রয় নেওয়ারা। বেশির ভাগ মানুষই আশ্রয় কেন্দ্রে আসেনি। যাদের গবাদি পশু রয়েছে, বেশির ভাগ তারাই এসেছেন। অনেকেই রাতে এসেছেন আবার রবিবার সকালে চলে গেছেন বলে জানা গেছে।

রবিবার সরেজমিনে উপকূলীয় রায়পুর ইউনিয়নের বিভিন্ন অঞ্চল ও আশ্রয় কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, উপজেলা প্রশাসন, স্থানীয় চেয়ারম্যান ও স্বেচ্ছাসেবক টিমের সদস্যরা আশ্রয় নেওয়াদের মধ্যে খাবার বিতরণ করছেন। খাবার বিতরণে স্থানীয় রায়পুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমিন শরীফ জানান, আমার উপকূলীয় ইউনিয়ন রায়পুরের ১৮টি আশ্রয় কেন্দ্রে প্রায় ৩ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। সঙ্গে রয়েছে তাদের হাঁস-মুরগীসহ গবাদি পশু। তাদের জন্যও ব্যবস্থা করা হয়েছে খাবারের। যেন খাবারের জন্য কাউকে কষ্ট পেতে না হয়। এছাড়াও রবিবার রাতের জন্য আয়োজন করা হয়েছে বিরানীর।

উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডা. সমরঞ্জন বড়–য়া জানিয়েছে, ‘আগামী কোরবানী ঈদকে সামনে রেখে উপকূলীয় অঞ্চলের অনেকেই গবাদি পশু পালন করেছেন। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে গবাদি পশু নিয়ে তারা পড়েছেন বিপাকে। বটতলী, বারশত ও রায়পুরের আশ্রয় কেন্দ্র গুলো ১২০০ গবাদি পশু রয়েছে। এ মুহুর্তে তাদের সবধরণের সহযোগিতা করার জন্য বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্র গুলোকে আমাদের টিম রয়েছে।’ এদিকে উপজেলা কৃষি সম্প্রাসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা সরোয়ার আলম জানান, উপজেলায় এবার বোরো মৌসুমে ৫ হাজার ৯৮০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়েছে। ঘুর্ণিঝড়ের আগে প্রায় ৯৮ শতাংশ জমির ধান কৃষকরা কেটে ঘরে তুলেছেন। ঘূর্ণিঝড়ে ধানের তেমন ক্ষতি হবে না বলেও জানান তিনি।

আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইশতিয়াক ইমন বলেন, আনোয়ারায় ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে উপকূলীয়সহ বিভিন্ন এলাকায় নেওয়া হয়েছে জরুরী সহায়তা ব্যবস্থা। ঘূর্ণিঝড় পরবর্তীতেও উপজেলা প্রশাসনের জরুরী সেবাকেন্দ্র চালু থাকবে। ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় জরুরি তথ্যসংগ্রহ ও ত্রাণ বিতরণের জন্য সার্বক্ষণিক নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে। এখনও পর্যন্ত কোথাও বড় ধরণের কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর আমরা পাইনি।

তিনি আরও বলেন, ৫৮টি আশ্রয় কেন্দ্রের মধ্যে ৩৩টি আশ্রয় কেন্দ্রে প্রায় ৫ হাজারের অধিক মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের জন্য শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানিসহ খাদ্য সামগ্রী পাঠানো হয়েছে পরিষদের চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে। জরুরী প্রয়োজনের ফায়ার সার্ভিস ও চিকিৎসকদের টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।