চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠানো রপ্তানি পণ্য চুরি করেই শতকোটি টাকার মালিক সাহেদ

তৈরী পোষাক বিদেশে রপ্তানি করতে চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠানোর পথে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে অভিনব কায়দায় চুরি করতো সাহেদ। কাভার্ডভ্যানের সিল বা তালা না ভেঙে সাহেদ ও তার সহযোগীরা খুলে ফেলতেন গাড়ির নাট বল্টু। কৌশলে খুলে ফেলতো কভার্ডভ্যানের উপরিকাঠামো। তারপর সবগুলো কার্টন খুলে প্রতিটি থেকে এক-তৃতীয়াংশ মালামাল চুরি করতো সাহেদ ও তার দল। চট্টগ্রাম বন্দরে যাতে ওজনে কম না হয় সেজন্য সেসব কার্টুন পূর্ণ করে দিতেন সমপরিমান অন্য যেকোন বস্তু দিয়ে। সীল অক্ষত ও ওজনে গরমিল না থাকায় সহজেই এসব পণ্য চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে উঠে যেতো জাহাজে।
এভাবেই দীঘদিন ধরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন অংশে রপ্তানির উদ্যেশ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠানো তৈরী পোষাক চুরি করে সাহেদ গড়েছে সম্পদের পাহাড়। বর্তমানে তার সম্পদের পরিমাণ ছাড়িয়েছে শত কোটিকেও। ৩০ কোটিরও বেশি টাকা দিয়ে দুই স্ত্রীর জন্য নির্মাণ করেছে ট্রিপ্লেক্স ও ডুপ্লেক্স বাড়ি। নামে বেনামে সাহেদের রয়েছে অন্তত ২০টি কাভার্ডভ্যান।

চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রপ্তানি হওয়া একটি শিপমেন্টের তৈরী পোষাক চুরির ঘটনার তদন্তে নামে র‌্যাব। সেই তদন্ত সূত্রে শুক্রবার মৌলভীবাজার, গোপালগঞ্জ ও ঢাকার আশপাশের এলাকা থেকে সাহেদ ও তার তিন সহযোগীকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। গ্রেপ্তার অন্য সহযোগীরা হলো ইমারত হোসেন সজল, শাহজাহান ওরফে রাসেল ওরফে আরিফ ও হৃদয়। শনিবার (৪ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ানবাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য জানায় র‌্যাব।

সাহেদের বাড়ি সিলেটের মৌলভীবাজারে হলেও রপ্তানির উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা তৈরী পোষাক ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে চুরি করার সুবিধার্থে সাহেদ বসবাস করতো চট্টগ্রাম শহরে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে রপ্তানির পোশাক চুরির বেশিরভাগ ঘটনা সাহেদের নেতৃত্বে হয়। তার এ অসাধু চক্রে গাড়িচালক, চালকের সহকারী, গুদামমালিক, গুদাম এলাকার আশ্রয়দাতা, চুরির মালামাল নামাতে দক্ষ কুলি, সর্দারসহ রয়েছে ৪০ থেকে ৫০ জন সদস্য। প্রতিটি কাভার্ড ভ্যান থেকে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার তৈরি পোষাক চুরি করার পর টাকারও হতো নির্দিষ্ট ভাগ-বাটোয়ারা।
চালককে ৩০ হাজার, চালকের সহকারীকে ২০ হাজার, গুদামের মালিককে ৫০ হাজার, গুদাম এলাকায় এই চক্রের আশ্রয়দাতাকে ৬০ হাজার টাকা ভাগ দেওয়া হতো প্রতি চুরিতে।

চট্টগ্রাম বন্দরে রপ্তানির উদ্দেশ্যে পাঠানো যেসব পণ্য চুরি হতো তাতে জড়িত থাকতো চালকরা। প্রতিষ্ঠান থেকে কাভার্ডভ্যানে পণ্য বোঝাই করার সময় তাদের ক্লিয়ারিং এন্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্ট ডিপোতে কাস্টম অফিসারকে পণ্যের প্রমাণ স্বরূপ দেখানোর জন্য ড্রাইভারকে দেয়া হয় পণের স্যাম্পল। ড্রাইভার সেসব স্যাম্পলের ছবি তুলে পাঠাতো সাহেদের কাছে। স্থানীয় স্টকলট ব্যবসায়ীকে সে স্যাম্পল দেখানোর পর পছন্দ হলেই সেই গাড়ি থেকে পণ্য চুরি করে সাহেদ। এমনই একটি ঘটনার তদন্তে নেমে সাহেদের সন্ধান পায় র‌্যাব।

চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠানো রপ্তানি পণ্য চুরি করেই শতকোটি টাকার মালিক সাহেদ 1

র‌্যাব জানায়, ২০২২ সালের ২৯ অক্টোবর গাজীপুর থেকে এ প্লাস সোয়েটার লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে সোয়েটার বোঝাই করে। সেসময় চালক শাহজাহানকে নমুনা হিসেবে কিছু সোয়েটার দেয় প্রতিষ্ঠানটি। শাহজাহান নমুনার ছবি তুলে সাহেদের কাছে পাঠান। সাহেদ এই ছবি তার অন্যতম সহযোগী তাওহীদুল ওরফে কাউছারের কাছে পাঠান। কাউছার যোগাযোগ করেন চালক শাহজাহানের সঙ্গে। কাউছারের নির্দেশে মধ্যরাতে ডেমরার মিরপাড়ার আয়েশা প্যাকেজিং ভবনের গুদামে কাভার্ড ভ্যান নিয়ে যান শাহজাহান। সেখানে কুলিসর্দার নাজিম, স্থানীয়ভাবে আশ্রয়দাতা মাসুম ওরফে মাসুদসহ আরও পাঁচ–সাতজন প্রতিটি কার্টন থেকে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ পণ্য সরিয়ে নেন। পরে পুনরায় প্যাকেজিং করে কাভার্ড ভ্যানটি বন্দরের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেয়।

তবে এ ঘটনাটি জানাজানি হয় গত ৬ জানুয়ারি। এদিন ‌‌‘এ প্লাস সোয়েটার লিমিটেড’কে একটি ভিডিও পাঠায় ব্রাজিলের ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ‘মিরসা’। তাতে বলা হয়, অক্টোবরে পাঠানো তাদের অনেকগুলো কার্টন ফাঁকা ছিল। এঘটনায় চুরি হওয়া পোশাকের সমপরিমাণ অর্থ জরিমানা পরিশোধ করে কারাখানা কর্তৃপক্ষ। ভিডিও বার্তা পেয়ে ঘটনাটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানায় এ প্লাস। এরপর ছায়াতদন্ত শুরু করে র‍্যাব। তদন্তে মেলে সাহেদের খোঁজ।

এতগুলো চুরির ঘটনা ঘটিয়েও বারবার পার পেয়ে যায় সাহেদ। ২০২১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর একটি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের পোশাক চট্টগ্রামে নেওয়ার পথে তেজগাঁও থেকে ১৭ হাজার ১৫২ পিস পোশাক চুরি হয়। এ ঘটনায় ১৭ সেপ্টেম্বর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় একটি মামলায় হয়। এ মামলার তদন্ত করতে গিয়ে মো. সাহেদসহ সাতজন গ্রেপ্তার করা হয়। ওই মামলায় গত ২৫ ডিসেম্বর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) সাহেদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। কিন্তু এর আগেই ছাড়া পেয়ে যায় সে।

র‌্যাব আরো জানায়, সাহেদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ১৭ থেকে ১৮টি রপ্তানির পোশাক চুরির মামলা রয়েছে। অধিকাংশ মামলাতেই সে কারাভোগ করেছে। তার বিরুদ্ধে ছয়টি মামলার বিচারকাজ চলমান।

মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।